যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স গতকাল রোববার পর্যন্ত লিবিয়ার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১২০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। শনিবার রাতে ‘অপারেশন ওডিসি ডন’ নামে লিবিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর এই অভিযান শুরু হয়।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি ও মিসরাতা শহরে কমপক্ষে ২০টি বিমান প্রতিরক্ষা স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, পশ্চিমা জোটের হামলায় ৬৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে।

গাদ্দাফি বাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে পশ্চিমা জোটের বিমান হামলায় বেশ কয়েকটি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়।
গতকাল বেনগাজি-আজদাবিয়াহ সড়ক থেকে তোলা।
এদিকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি বলেছেন, ‘লিবিয়ায় হামলা চালানোর কোনো অধিকার পশ্চিমা বাহিনীর নেই। আমরা দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির জন্য যুদ্ধ করব।’
গাদ্দাফিবিরোধীদের দখলে থাকা লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি সেনাদের সংঘর্ষে গত দুই দিনে ৯৪ জন নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান মাইকেল মুলেন গতকাল জানিয়েছেন, যৌথ বাহিনীর হামলার পর গাদ্দাফি বাহিনী বেনগাজিতে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা বন্ধ করেছে। এর মাধ্যমে লিবিয়ায় নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক বাহিনীর অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। গাদ্দাফিকে এখনই ক্ষমতাচ্যুত করাটা জরুরি নয়।
ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা: মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনের বিবৃতিতে জানানো হয়, শনিবার রাত থেকে লিবিয়ার ওপর হামলা চালানো শুরু হয়। রোববার পর্যন্ত লিবিয়ার বিমান প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে অন্তত ১১০টি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী ও ডুবোজাহাজ থেকে এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমানের সহায়তা নিয়ে রোববার সকালে লিবিয়ার স্থলবাহিনীকে লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করেছে মার্কিন যুদ্ধবিমান। এ সময় দেশটির বিমান প্রতিরক্ষা স্থাপনাতে বোমা হামলা চালানো হয়। রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম তিনটি বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান, এফ-১৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমানসহ ১৯টি জঙ্গি বিমান এতে অংশ নেয়। বি-২ বোমারু বিমান থেকে বিভিন্ন স্থানে ৪০টি বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ব্রিটিশ ডুবোজাহাজ ও জঙ্গি বিমান থেকে লিবিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মিসরাতাতেও হামলা চালানো হয়েছে।
ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র জানান, গতকাল ১৫টিরও বেশি ফরাসি যুদ্ধবিমান লিবিয়ায় হামলায় অংশ নেয়। ওই মুখপাত্র আরও জানান, হামলায় অংশ নিতে কাতার চারটি যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, গাদ্দাফির বাব আল-আজিজিয়া প্যালেসের কাছেও বোমা হামলা চালানো হয়েছে। গতকাল স্থানীয় সময় সকালের দিকে ত্রিপোলিতে বিমানবিধ্বংসী গোলা ও বেশ কিছু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। বিবিসির প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক জানান, ত্রিপোলির পূর্বাঞ্চলের সাবানি ও ঘাসির এলাকা এবং বিমানবন্দর সড়কে হামলা চালানো হয়েছে। এসব এলাকায় লিবিয়ার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। রয়টার্সের প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক জানান, তিনি বেনগাজিতে ফরাসি বিমানের হামলায় বিধ্বস্ত একটি গাড়ি ও ১৪টি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন।
বেনগাজি ও আজদাবিয়াহ শহরের সংযোগ সড়কে পশ্চিমা জোটের বিমান হামলায় গাদ্দাফি বাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। লিবিয়া ফ্রান্সের একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে বলে দাবি করলেও ফ্রান্স তা নাকচ করে দিয়েছে।
লিবিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়েছে, পশ্চিমা জোটের বোমা হামলায় ৬৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ১৫০ জন। টেলিভিশন ফুটেজে দেখানো হয়, বিদ্যালয় ও হাসপাতালের মতো বিভিন্ন বেসামরিক স্থাপনাতে পশ্চিমা জোট হামলা চালিয়েছে। এতে আরও দেখানো হয়, গাদ্দাফির সমর্থকেরা তাঁর বাব আল-আজিজিয়া প্যালেসের বাইরে অবস্থান নিয়ে প্রিয় নেতাকে বাঁচাতে মানববর্ম তৈরি করেছে। একই ধরনের মানববর্ম তৈরি করা হয়েছে লিবিয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও।
ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন বিবিসি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, হামলায় বেসামরিক জনগণ হতাহতের ঘটনা এড়াতে যুক্তরাজ্য ‘সব ধরনের সতর্কতা’ অবলম্বন করছে। লিবিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজ দেখার পর আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মার্কিন নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল ইউলিয়াম ই গর্টনে বলেন, জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য লিবিয়ার ওপর এই হামলা চালানো হয়েছে। অভিযানের প্রথম পর্যায় এটি।
পশ্চিমা জোট বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, উপগ্রহের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এসব পর্যালোচনা করে নতুন নতুন স্থাপনায় হামলা চালানো হবে।
অভিযানের সফলতা দাবি: লিবিয়ায় অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য সফল হয়েছে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান মাইকেল মুলেন বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল লিবিয়ার জনগণকে রক্ষা করা। নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠা করা। গাদ্দাফি বাহিনী বেনগাজিতে হামলা বন্ধ করেছে। তাই বলা যায়, লিবিয়ায় অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।’
মাইক মুলেন গতকাল ফক্স নিউজকে জানান, গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা বা তাঁর ওপর হামলা চালানোর বিষয়টি এ মুহূর্তে মুখ্য বিষয় নয়। তাঁর নিষ্ঠুরতার হাত থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষা করে মানবিক সহায়তা দেওয়াই এখন প্রধান কাজ।
হামলা বৈধ: মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা লিবিয়ায় হামলাকে বৈধ বলে উল্লেখ করেছেন। ব্রাজিল সফরে লিবিয়া অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একজন নৃশংস শাসক নিজের দেশের জনগণকে হত্যা করলে আমরা তাঁর পাশে থাকতে পারি না।’ তবে তিনি বলেন, মার্কিন স্থলবাহিনী এই অভিযানে অংশ নেবে না।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন লিবিয়ায় হামলাকে ‘প্রয়োজনীয়, বৈধ ও সঠিক সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি গাদ্দাফিকেই দায়ী করেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি বলেন, গাদ্দাফির ‘খুনের উন্মত্ততা’ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় লিবিয়ায় হামলা চালিয়েছে।
গাদ্দাফির ভাষণ: রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে গতকাল গাদ্দাফি বলেন, পশ্চিমা জোটের হামলার মধ্য দিয়ে লিবিয়া ‘ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে’ পরিণত হয়েছে। এই হামলাকে তিনি ‘বর্বরোচিত, অন্যায় আগ্রাসন’ বলে উল্লেখ করেন। গাদ্দাফি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ব্রিটেনসহ খ্রিষ্টান শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তারা আমাদের তেলসম্পদ লুট করতে চায়।’
গাদ্দাফি বলেন, ‘আমরা মাতৃভূমি ও জনগণকে রক্ষায় লড়াই করছি। লিবিয়ার জনগণ ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। সবার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। লিবিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের আগ্রাসন রুখে দেওয়া হবে।’ গাদ্দাফি লিবিয়ার জনগণকে অস্ত্র তুলে নিয়ে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘হিটলার-মুসোলিনির মতো আপনাদেরও পতন হবে।’
গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম বলেন, লিবিয়া হামলা চালানো পশ্চিমা জোটের আর একটি গুরুতর ভুল। যে ভুল করে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের নামে ইরাকের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল, তেমন ভুল করেই লিবিয়ায় হামলা চালানো হচ্ছে।
বেনগাজিতে দুই দিনে নিহত ৯৪: পশ্চিমা জোটের হামলার আগে বেনগাজিতে গাদ্দাফির অনুগত সেনাদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। বেনগাজির জালা হাসপাতালের চিকিৎসক খালেদ মুগাসাবি বলেন, ‘গত শুক্রবার আমরা অন্তত ৫০টি মরদেহ পেয়েছি। শনিবার পেয়েছি আরও ৩৫টি মরদেহ।’ এএফপির প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক জানান, জালা হাসপাতালের এই ৮৫টি মরদেহ ছাড়াও তিনি পৃথক স্থানে আরও নয়টি মরদেহ দেখতে পেয়েছেন।
রাশিয়া, চীন ও আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) যুদ্ধ বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়া বলেছে, এ জাতীয় হামলা জাতিসংঘের প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
আরব লিগের মহাসচিব আমর মুসা লিবিয়ার ওপর হামলার সমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা লিবিয়ার জনগণকে রক্ষা ও দেশটিতে নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার পক্ষে। কিন্তু এর নামে লিবিয়ায় বোমা হামলার বিষয়টি সমর্থন করা যায় না।’
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া লিবিয়ায় অভিযানসংক্রান্ত প্রস্তাব পাসের ভোটাভুটি থেকে বিরত ছিল। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠাসহ ‘প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ’ নেওয়ার প্রস্তাব পাস হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৬৯ সালে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসেন সেনা কর্মকর্তা গাদ্দাফি। তাঁর প্রায় ৪২ বছরের শাসনের অবসানের দাবিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা বেনগাজি ও ত্রিপোলির পশ্চিমের শহর জাবিয়াহসহ বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয়। গাদ্দাফির অনুগত সেনাদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। সূত্র: এএফপি, বিবিসি, আল-জাজিরা, রয়টার্স।
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।