সম্পত্তি কর আরোপ নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন

রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০১১

প্রস্তাবিত আয়কর আইনের খসড়ায় সম্পদ কর আরোপের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হচ্ছে না। সম্পদ করের পরিবর্তে সম্পত্তি কর আরোপ করা হবে। অর্থাৎ শুধু জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটের ওপর প্রতিবছর এই সম্পত্তি কর দিতে হবে। অবশ্য মালিক নিজে বসবাস করলে এবং একাধিক ফ্ল্যাট বা বাড়ি না থাকলে জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের ওপর কর বসবে না।

রাজধানী ঢাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন
রাজধানী ঢাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন

তবে সম্পত্তি কর আরোপের এই উদ্যোগে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। বিশেষ করে, সম্পত্তির মালিক একজন করদাতা দ্বৈত করারোপের সম্মুখীন হতে পারেন কিংবা অবসর গ্রহণের ওপর কোনো আয় না থাকলেও সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত সামান্য আয়ের জন্য কর দিতে বাধ্য হতে পারেন বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ অবস্থায় সম্পত্তি করের বিষয়টি নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (আয়কর নীতি) আমিনুর রহমানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ দল প্রস্তাবিত আয়কর আইনের খসড়ার সম্পদ কর অংশে পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করছে। এই কমিটিতে ব্যবসায়ী, চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধি রয়েছেন। আজ শনিবার এই বিশেষজ্ঞ দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তবে দলটি পুরো খসড়া আইন নিয়েই কাজ করবে।
সরকার ২০১২ সালের জুলাই মাস থেকে নতুন আয়কর আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর আগে সমাজের সব শ্রেণী-পেশার লোকজনের সঙ্গে খসড়া আইন, বিশেষ করে সম্পত্তি কর আরোপের ওপর মতামত নেবে এনবিআর। এরপর ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে আইনটি পাস করা হবে।
প্রস্তাবিত আয়কর আইনের খসড়ায় শহরাঞ্চলের জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ স্থাবর ও অস্থাবর সব ধরনের সম্পত্তির ওপর কর বসানোর প্রস্তাব ছিল। খসড়ায় করের হারও নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিন্তু গত ১৫ জানুয়ারি খসড়া প্রকাশের পরপরই সরকারের নীতিনির্ধারক মহলসহ সমাজের নানা স্তর থেকে সম্পদ কর আরোপের বিরোধিতা করা হয়। ফলে খসড়া আইন প্রকাশ করা হলেও সম্পদ করারোপের বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তন করে এনবিআর।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সম্পত্তি কর হারেও কিছুটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করে এই করের হার দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। খসড়ায় করের হার ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়া এনবিআর শুধু রাজধানী ঢাকাসহ সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটের ওপর সম্পত্তি কর আরোপের কথা ভাবছে। তবে ৫০০ বর্গমিটার পর্যন্ত জমির মালিককে সম্পত্তি কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে।
এ ছাড়া আয়কর আইনের খসড়ায় কর আরোপের প্রস্তাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত নগদ টাকার ওপর কর বসানো হচ্ছে না।
জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মূল্য আর্থিক অঙ্কে নির্ধারণ করে তার ওপর কর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার-নির্ধারিত জমি ও বাড়ি বা ফ্ল্যাটের দামের ওপর এই কর বসবে।
বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য প্রথম আলোকে জানান, খসড়া আইনটিতে সম্পদ বা সম্পত্তি কর সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। মতামতের ভিত্তিতে এতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ইতিমধ্যে সম্পদ করের পরিবর্তে সম্পত্তি কর আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এনবিআর চায় না সম্পত্তি কর আরোপ নিয়ে করদাতাদের মধ্যে একটি নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হোক। এমন করদাতাও রয়েছেন, যাঁদের বার্ষিক আয় এখন করসীমার নিচে রয়েছে। কিন্তু ওই করদাতার অনেক সম্পত্তি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সম্পত্তি কর আরোপে কিছুটা ছাড় দেওয়া হতে পারে।
খসড়ায় যা আছে: খসড়া আয়কর আইনের ১০ নম্বর অধ্যায়ে সম্পদ করের কথা বলা হয়েছে। আইনের ১২৭, ১২৮ ও ১২৯ ধারায় এই কর সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে। প্রতি করবর্ষের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্জিত সম্পদের ওপর কর দিতে হবে।
খসড়া আইন অনুযায়ী, প্রথম ৩০ লাখ টাকার সম্পদের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী তিন লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৩০ লাখ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এর পরও বেশি থাকলে তার ওপর ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
খসড়া অনুযায়ী, নিজে বসবাস ছাড়া বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট, পৌর এলাকার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত খামার, পৌর এলাকার জমি ও বাড়ি এই করের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ ছাড়া দুই লাখ টাকার বেশি থাকলেও তার ওপর কর বসবে।
তবে কোনো করদাতা যদি কোনো বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টে বছরের ৩০০ দিনের বেশি বসবাস না করেন, তাহলে তাঁকে ওই বাড়ির ওপর সম্পদ কর থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়। বাণিজিক উদ্দেশ্যে নির্মিত ভবনও সম্পদ কর থেকে অব্যাহতি পাবে।
কোনো অনাবাসী বাংলাদেশি নাগরিকের যদি দেশের বাইরে সম্পদ থাকে, তার ওপর কোনো কর দিতে হবে না। ৫০০ বর্গমিটারের অনধিক প্লট বা একটি বাড়ি কিংবা বাড়ির একটি অংশের মালিক হলেও তাঁকে কর দিতে হবে না। কোনো কোম্পানি ও তার কর্মচারীর জন্য শুধু আবাসিক ব্যবহার্য বাড়ির ওপর সম্পত্তি কর বসবে না।
তবে গাড়ি, হেলিকপ্টার ও এয়ারক্রাফট, দামি অলংকার, নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন, চিত্র, ভাস্কর্য ও দেশের বাইরে কোনো ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত থাকলে সম্পদ কর দিতে হবে। এমনকি ৫০ হাজার টাকার বেশি দামি ঘড়ি ব্যবহার করলেও কর দিতে হবে। এ ছাড়া দুই লাখ টাকার বেশি নগদ অর্থ থাকলেও করের আওতায় আসবেন করদাতারা।
কিন্তু বিভিন্ন মহলের আপত্তির কারণে এনবিআর উল্লিখিত প্রস্তাবের অনেক কিছুই বাদ দিয়ে আইন চূড়ান্ত করতে পারে বলে জানা গেছে। সে কারণেই সম্পদ করের বদলে সম্পত্তি করের দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআরের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, জমি ও বাড়ির ওপরই কেবল সম্পত্তি কর আরোপ করা হবে। গাড়ি, ঘড়ি বা স্বর্ণের ওপর করা হবে না। আর কৃষি জমি এই করের আওতায় আসবে না।
দ্বৈত কর বিতর্ক: এদিকে সম্পত্তি কর আরোপ করা হলে সিটি করপোরেশন বা পৌর এলাকার একই জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটের ওপর দুবার করারোপ হবে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেননা, সিটি করপোরেশন বা পৌর এলাকার নাগরিকেরা নিজস্ব বাড়ি বা ফ্ল্যাটের জন্য হোল্ডিং ট্যাক্স বা পৌর কর দিয়ে থাকেন।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকেও বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এ ছাড়া এনবিআরে চলমান ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশগ্রহণকারী অনেকেই সম্পত্তি কর আরোপের বিরোধিতা করেন। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রতিনিধি এ সময় বলেন, রিয়েল এস্টেট শিল্পের মাধ্যমে অনেক লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠছে। এ ছাড়া অধিক লোক ফ্ল্যাটের মালিক হলে সরকার ওই খাতে রাজস্ব চাহিদা পূরণ করতে পারবে। এ অবস্থায় সম্পত্তির ওপর কর বসালে এই খাতে নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
অবশ্য এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করে বলেন, সিটি করপোরেশন বা পৌর এলাকায় কর নেওয়া হয় স্থানীয়ভাবে রাস্তাঘাট উন্নয়নসহ অন্যান্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য। আর এনবিআর যে কর নেয়, তাতে রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সেবা দেওয়ার জন্য বা বৃহত্তর আঙ্গিকে চিন্তা করতে হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান আমলে প্রথম সম্পদ কর চালু হয়। তখন থেকেই এ দেশের মানুষকে সম্পদ কর দিতে হয়। পরে স্বাধীনতার পরও তা অব্যাহত রাখা হয়। আইন প্রণেতা ও সমাজের প্রভাবশালীদের চাপে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে সম্পদ কর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে সে সময় কোনো ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতার এক-তৃতীয়াংশের বেশি সম্পদ কর হিসেবে নেওয়া যেত না।
প্রস্তাবিত সম্পত্তি করেও এ ধরনের সুযোগ রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে। এতে বাড়ি, জমির মালিক অবসরপ্রাপ্ত ও প্রবীণ করদাতারা, যাঁদের বার্ষিক আয় ন্যূনতম করসীমার নিচে রয়েছেন, তাঁরা উপকৃত হবেন।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সম্পত্তি বা সম্পদ কর দেওয়ার বিধান রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৫৭ সালে প্রথমে ভারতে সম্পদ কর চালু করা হয়। প্রতিবছর ভারতীয় নাগরিকদের নিট সম্পদের ওপর কর দিতে হয়। সম্পদ কর না দিলে জেল-জরিমানার বিধানও রয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও সম্পদ কর চালু রয়েছে।

0 আপনার মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।

Avro Keyboard - Unicode Compliant FREE Bangla Typing Softwareবাংলা লিখার সপ্টওয়্যার আভ্র ডাউনলোড করতে খানে ক্লিক করুন
 
 
 

বিশাল বাংলা

কম্পিউটার প্রতিদিন

রাজনীতি...

বিনোদন

খেলার খবর

অর্থ ও বাণিজ্য