ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল। অবৈধ ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়া বন্ধ করতে আদালতের নির্দেশে সংবিধান সংশোধন এখন এক অপরিহার্য্য বিষয়। কেউ বলছে না সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই, কিন্তু আপত্তি হলো সংশোধন কমিটি নিয়ে। সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের সংবিধান সংশোধন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিএনপি বলছে এই কমিটি অবৈধ। কেন তারা অবৈধ বলছে তার কোন ব্যাখা দিচ্ছে না। হয়ত তারা সুযোগ খুঁজচ্ছে নতুন একটি আ›্দােলনের মাত্রা তৈরীর। তবে সংবিধান সংশোধনকে কেন্দ্র করে যদি তারা কিছু করতে চায় তাহলে তাদেরকে পরিস্কার করে বলতে হবে কি তারা চায় এবং কেন চায়। বৈধতার প্রশ্নটি তখনই আসে যখন উদ্যোক্তা নিজেই অবৈধ থাকেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ কিন্তু বিএনপির নেই।
তারপরও বিষয়টি সার্বজনীন করার জন্য বিএনপি দাবি তুলতে পারে সকল রাজনৈতিক জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করার। এও বলতে পারে, জামাতকে না নিলে আমরা এই কমিটিতে থাকব না। কোন কিছুই বলছে না তারা। সুতরাং ধরে নিতে হবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে।
অবৈধভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে ? ক্ষমতা দখলের এই অবৈধতায় দেশবাসী কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো এখন বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীরি প্রথমে হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। যারা তাকে হত্যা করেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তারা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এলেও তাদেরকে পাকিস্তানিরাই যুদ্ধে নাম লেখাতে সহযোগিতা করেছিল। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর নানা কথায় এবং কাজে ইতিমধ্যে তা প্রমাণও হয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ক্ষমতা দখলের অস্থির পরিবেশ থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসার সুযোগ হয়। তার মানে এই নয় জেনারেল জিয়া এই হত্যাকান্ডকে সমর্থন করেছেন। এখন যারা জিয়ার দল করেন তারা যদি এইটাকে বৈধ বলতে চান তাহলে তা হবে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা থেকে তাদের সামরিক পৃষ্টপোষকতার দিকে ফিরে যাওয়া। এটা নিশ্চয়ই তারা চান না।
ঘাতকরা জিয়াকে ক্ষমা করেনি। যখন বিধবা হওয়ার কথা নয় তখন বিধবা হয়েছেন বেগম জিয়া ।
যারা জিয়াকে হত্যা করেছে তারাও গণতন্ত্রের পৃষ্টপোষক নয়। বিএনপির নিশ্চয়ই মনে আছে কোন ফাঁদ পেতে বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। সংগত কারণেই আওয়ামী লীগের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগকে বিএনপির স্বাগত জানানো উচিত।
সামরিক ব্যক্তিদের অনেকের খায়েশ থাকে অবসরে গিয়ে রাজনীতি করার । রাজনৈতিক দলগুলোও মনে করে এদেরকে দলে টানতে পারলে সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাওয়া যাবে । কিন্তু এটা যে একটা ভুল চিন্তা তা এতদিনে প্রমাণ হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনী গণতন্ত্রকে রক্ষা করে বটে কিন্তু গণতন্ত্র হরণের অধিকার রাখে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর একাধিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান নিহত হয়েছেন বিপথগামী সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হাতে। শুধু কি তাই ? কতজন তাদের হাতে নিহত হয়েছেন সে বিষয় এখন পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। বিএনপি নিশ্চয়ই চায় না আগামী দিনগুলোতে এই ঘটনা ঘটতে থাকুক। বিএনপির সুযোগ ছিল তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন ঠিক একই ধরনের উদ্যোগ নেয়ার কেন তারা সে কাজটি করেননি এখন সে প্রশ্ন করা অবান্তর হলেও মানতেতো হবেই আওয়ামী লীগ সুযোগের সঠিক ব্যবহার যথাসময়েই করছে।
লক্ষণীয়, বারবার অবৈধ ক্ষমতা দখলের সময় সামরিক সেনারাই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছে। সামরিক ব্যারাকে অনেক সেনার স্ত্রী সন্তান ও আতীœয় স্বজনের আহাজারিতে বাতাস ভারাক্রান্ত। গত ২০০৫ সালে হাইকোর্ট থেকে একটি ঐতিহাসিক রায় দেওয়া হয়। যে রায়ে বলা হয়েছে, মার্শাল ল জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল অবৈধ।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধানে জনগণকে সর্বক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্র ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই উন্নতি করতে পারেনি। যে সব দেশ আজ উন্নত তাদের সবাই গণতন্ত্রের অনুসারী। কিন্তু আমাদের দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর থেকে বারবার সংশোধনী এনে সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে ।
সামরিক ফরমান জারি করে সংবিধান পরিবর্তন,পরিবর্ধন ও সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান ও আর্মি এক্টের কোথাও মার্শাল ল জারির কথা নেই। অথচ ১৯৭৭ সনের ২২ এপ্রিল এক ফরমানের মাধ্যমে একজন আর্মি ডিক্টেটর নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন।
বিএনপি সংবিধান সংশোধনের কমিটিতে কোন নাম দেয়নি। উপরন্ত সংবাদ সম্মেলন করে কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল চেতনার দিক নির্দেশনায় ঐতিহাসিক ৬-দফা ও ১১-দফায় সুষ্পষ্ট বলা হয়েছে, সংসদ একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান । সরকার আইন সভার নিকট দায়ী থাকবে । আইন প্রনয়ন করার দায়িত্ব সংসদের । আদালত আইনের রক্ষক। এবং এই চেতানায় সম্মৃদ্ধ হয়েই ৭২ এর সংবিধান গৃহীত হয়। কিন্তু যখন যার যেভাবে প্রয়োজন হয়েছে ঠিক সেইভাবেই আমাদের পবিত্র সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করেছে। এখন সময়ের প্রয়োজনে এই বিক্ষত সংবিধানকে জীবন্ত, প্রানবন্ত করতেই সংসদের উদ্যোগ, আর এই উদ্যোগকে অবৈধ বললে সংসদ সার্বভৌম হয় কিভাবে ?
তাই অধিকাংশ বিশেষঞ্জ ও ব্যাপক জনগোষ্টীর স্বাভাবিক আশা দেশ ও জাতির সর্বোচ্চ রক্ষা কবজ এই সংবিধানের প্রশ্নে আমরা সবাই যেন দায়িত্ববান হই। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহের অভিজ্ঞ প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিকুল হক কমিটিতে বিশেষজ্ঞ নেই বলে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। সে সাথে অত্যন্ত সতর্ক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সংবিধান এবং আইন বিষয়ে কতটা অভিজ্ঞ তা নিয়ে সংশয়ের পরেও তারা কতটা সফল হয় তা দেখতে হবে।
প্রবীণ এই আইনজীবীর মতে সংবিধার প্রণেতাদের মধ্যে ব্যারিষ্টার মাহম্মুদুল ইসলাম ও ড: কামাল হোসেন এখনও জীবিত আছেন। তাদের স্থান কমিটিতে হয় নাই। আমরা কিন্তু হতাশ হব না, এই ভেবে যে , সংসদের আইন প্রণেতাদের সমন্বয়ে কমিটিতে সংসদ সদস্যদের বাইরে থেকে কারো নাম আসলে আরও অনেক নামের প্রস্তাব আসতে পারে ।
কে আছেন কে নেই এই নিয়ে বিতন্ডায় যাওয়ার চাইতে যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তাদেরকে সুষ্ঠভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত। অতীতে যারা ছিলেন প্রয়োজনে তারা পরামর্শ দিতে পারেন কিন্তু তাদের চেয়ে ভালো চিন্তা অন্যরা করতে পারবেন না এমনটা চিন্তা করা উচিত নয়।
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।