বাংলাদেশের কিশোর কিশোরীরা বর্তমানে নানা ধরনের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে চলছে। এরমধ্যে যেটি আমাদের সবচেয়ে আতঙ্কিত ও চিন্তিত করে তুলছে তার নাম ইভটিজিং। ইভটিজিং এর ‘ইভ’ বলতে সাধারণত নারীদের বুঝানো হয়।
‘টিজ’- ইংরেজি শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিরক্ত করা। সাধারণত ইভটিজিং বলতে রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ ও অন্যান্য যে কোন স্থানে মেয়েদের উত্যক্ত করা বা লাঞ্ছিত করাকেই বুঝানো হয় । ইভটিজিং শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। ইভটিজিং এর ফলে কী ঘটে তার কিছূ অংশ আমরা প্রতিদিনের পত্রিকায় পাই । তার বাইরে আর যা ঘটে তার অধিকাংশই আমাদের অজানা থেকে যায়। বর্তমানে পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে ইভটিজিং প্রতিরোধে নানা ধরনের কর্মসূচি। মানব বন্ধন, র্যালী , আলোচনা সভা , সেমিনার আরও অনেক কিছু। আবার ইভটিজিং করার জন্য ছেলেদের মুচলেকা দেয়া এমনকি কান ধরে ওঠ বস করানো হচ্ছে।
ইভটিজিং এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা নানারূপ সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কার্যক্রম করে যাচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। তাছাড়া এসংক্রান্ত কঠোর আইন প্রণয়নের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। প্রচলিত আইনে শাস্তিও দেয়া হচ্ছে। এরফলে পরিবর্তন কতটা হয়েছে তা আমাদের ভাবতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে কেবল শাস্তি প্রদানই একমাত্র সমাধান নয়। আরও মনে রাখতে হবে যারা ইভটিজিং করে এবং যারা এর শিকার হয় তারাও আমাদেরই সন্তান।
তাদের বুঝানোর দায়িত্ব আমার, আপনার , সমাজের সকলের। প্রধান দায়িত্ব বর্তায় পরিবার ও বিদ্যালয়ের। আসলে নিজে বদলালে অন্যদেরও বদলাতে সহায়তা করা যাবে এবং বদলাতে উৎসাহিত করা সহজতর হবে। তাই আগে চাই নিজেদের বদলানো। এই বদলানো কেবল বাইরে থেকে হলে হবে না ভিতর থেকে নিজেদের বদলাতে হবে সবার আগে। মানুষের ভিতর থেকে বদলানোর জন্য প্রয়োজন যথাযথ শিক্ষা। যে শিক্ষা কিশোর কিশোরীসহ সবাইকে যে কোন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেকে সমর্থ করে তুলতে সক্ষম করবে। এই সামর্থ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাক্রম এ সকল দক্ষতা অর্জনে সহায়ক নয়। বলা হয়ে থাকে, আমাদের শিক্ষাক্রম জ্ঞানভিত্তিক। শুধু জ্ঞান দিয়ে জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধান করা যায় না।
প্রয়োজন জ্ঞানকে দক্ষতায় পরিণত করে তার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন। আর এ বিবেচনায়ই আমাদের আনুষ্ঠানিক মাধ্যমিক শিক্ষায় জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা অন্তর্ভূক্ত করা এখনই জরুরী। কেননা ইভটিজিংসহ আরও নানারূপ সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার বয়সেই কিশোর কিশোরীরা মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করে। তাছাড়া এ বয়সের অন্তর্ভূক্ত যারা স্কুলে যেতে পারে না তাদেরও সুযোগ রয়েছে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সমবয়সীদের কাছ থেকে শেখার। আবার শিক্ষক শিক্ষিকারাই হতে পারেন অনানুষ্ঠানিকভাবে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কর্মসূচির প্রধান নিয়ামক। আর এজন্য প্রয়োজন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত ১০টি জীবন দক্ষতা আয়ত্ত ও আত্মস্থ করা। এই ১০ টি জীবন দক্ষতা হচ্ছে - আত্ম সচেতনতা, সহমর্মিতা, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা, বিশ্লেষণমূলক চিন্তন দক্ষতা, সমস্যা সমাধান দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, আবেগ সামলানোর দক্ষতা ও চাপ মোকাবেলার দক্ষতা।
এ সকল দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কীভাবে ইভটিজিং করা থেকে নিজেকে ও অন্যকে বিরত রাখা যায় এবং ইভটিজিং পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে ইভটিজিং এর শিকার ব্যক্তিকে কীভাবে সহায়তা করা যায় তার সবই অর্জনের পথ রয়েছে এই জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে। সীমিত পরিসরে সকল উপাদান আলোচনা করা সম্ভব নয়, তাই এখানে ইভটিজিং এর শিকার একজনের প্রতি অন্যজনের সহমর্মিতা প্রকাশ করার দক্ষতা কীভাবে শেখানো হবে তার একটি উদাহরণ তুলে ধরব। যে কিশোর বা কিশোরী ইভটিজিং এর শিকার হয় তার দূরবস্থার কোন সীমা থাকে না। কেউ কেউ পরিবারে নিগৃহীত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় খোঁজে। কেউ কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার কেউবা আরও ক্ষতিকর পথ বেছে নেয়।
এর কোনটিই সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ গঠনের সহায়ক নয়। ইভটিজিং এর শিকার ব্যক্তির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য যা করা যেতে পারে তা হচ্ছে-১. তারা যে অপরাধী নয় এ বলে সান্তনা দিতে হবে;২. ভূক্তভোগী ও তার পরিবার নিরাপরাধ বলে প্রচার চালিয়ে তাদের প্রতি সামাজিক সহানুভূতি সৃষ্টি করতে হবে; ৩. ইভটিজিং এর শিকার ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করতে হবে; ৪. ইভটিজিং এর শিকার ব্যক্তির সঙ্গ ত্যাগ না করে তাকে আরও বেশি সঙ্গ, শক্তি ও সাহস যোগাতে অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। উল্লিখিত কাজগুলো যদি জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার পর্যায়ে উন্নীত করা যায় তবে ভেতর থেকে পরিবর্তন করা সম্ভব অন্যথায় নয়।
আর মানুষের ভেতর থেকে পরিবর্তন আনার জন্যই প্রয়োজন জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষাক্রমে অন্তভূক্ত করা। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের এ দক্ষতা অর্জন করাতে হবে যে ইভটিজিং এর শিকার হলে কীভাবে খাপ খাওয়াতে হয় ? ইভটিজিং থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হলে কী করতে হবে? অন্যদের বিরত রাখতেইবা কী করা উচিত? এ বিষয়গুলো কেবল মুখস্ত নির্ভর নয়। বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে বিভিন্ন কেস স্টাডি বা ভূমিকাভিনয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শেখাতে হবে যাতে তারা এ দক্ষতাগুলো অর্জন করতে সক্ষম হয়। মনে রাখতে হবে জীবন দক্ষতা এমন দক্ষতা যা জীবিকার্জনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় তবে জীবন ঘনিষ্ঠ যে কোন সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ বা পরিস্থিতি মোকাবেলার সহায়ক।
এক কথায় মনোসামাজিক দক্ষতাসমূহই জীবন দক্ষতা। ইভটিজিং মোকাবেলা একটি মনোসামাজিক চ্যালেঞ্জ। কাজেই ইভটিজিং প্রতিরোধে অন্যান্য সকল ব্যবস্থার পাশাপাশি কিশোর কিশোরীদের ভিতর থেকে পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা অন্তর্ভূক্ত করা। তাহলেই আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার উপযোগী কিশোর কিশোরী সমৃদ্ধ এক শক্তিশালী বাংলাদেশ।
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।