মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের চরবৈষ্ণবী গ্রামের দিনমজুর বিল্লাল শেখের চার ছেলেমেয়ের কেউই কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি। স্কুলে যাওয়ার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাঁর বড় মেয়ে বিলকিস আক্তারকে (১২)। ছেলে হাকি শেখ (১০), মো. তালুকদার (৮) ও ছোট মেয়ে ফতে খাতুনেরও (৭) কখনো স্কুলে যাওয়া হয়নি। শুধু বিল্লাল শেখের ছেলেমেয়েরাই নয়, যমুনা নদীতীরবর্তী ওই গ্রামের শিক্ষার চিত্র প্রায় একই।
চরবৈষ্ণবী গ্রামটিতে পরিবারের সংখ্যা ২৫০। এসব পরিবারে বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪০০, যাদের বেশির ভাগই স্কুলে যায় না। গ্রামটিতে একটি আনন্দ স্কুল থাকলেও সেটি কালেভদ্রে খোলা হয়। ওই স্কুলে ৩০ জন ছাত্রছাত্রীর বেশির ভাগ নিজেদের নামটাই লিখতে পারে না।
গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহমানের মেয়ে রহিমা খাতুন (১২) চরবৈষ্ণবী গ্রামের গেদা ঘোষের বাড়ির আনন্দ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে চার বছর ধরে সে ওই স্কুলেই পড়ালেখা করছে। কিন্তু সে কোনো পাঠ্যবইয়ের নামই বলতে পারে না।
রহিমার মা মমতা খাতুন বলেন, ‘আমাগো বাড়ির থিকা হরকারি (সরকারি) পাইমারি স্কুল সাত মাইল দূরে। হেনে যাইতে চাইরডাখাল পার অইতে অয়। তাই আমার চাইরডা পুলামেয়ার কাউরেই পড়াইবার পারি নাই। অনেক শক কইরা বড় মেয়াডারে আনন্দ স্কুলে বতি (ভর্তি) করচিলাম। কিন্তু স্কুলই খুলে না, পড়া লেহা আর কি শিকবো।’
শিবালয়ের আরিচা বন্দর থেকে নৌপথে অন্তত ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পাবনার সীমান্ত এলাকায় চরবৈষ্ণবী গ্রামের অবস্থান। চারদিকে যমুনা নদীঘেরা ওই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছোট ছোট ছনের ঘর। বিদ্যুত্, রাস্তাঘাটসহ নাগরিক-সুবিধা বলতে কিছুই নেই গ্রামটিতে। দু-একটি পরিবার ছাড়া মাছ ধরা আর অন্যের বাড়িতে মজুরি খাটাই তাদের মূল পেশা।
১৬ অক্টোবর ওই গ্রামে গেলে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ক্ষুব্ধ মনোভাব প্রকাশ করেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। গ্রামের কৃষক আকতার হোসেন, হারুন আলী শেখ ও রহম আলী জানান, গ্রামের প্রতিটি পরিবারেই চার থেকে সাতজন করে বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশু রয়েছে। শুধু বিদ্যালয়ের অভাবে এই ছেলেমেয়েদের তাঁরা পড়ালেখা করাতে পারেন না।
চরবৈষ্ণবী গ্রাম থেকে কাছের যে বিদ্যালয়, সেটির নাম মধ্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই গ্রাম থেকে বিদ্যালয়টির দূরত্ব অন্তত ছয় কিলোমিটার। ছেলেমেয়েরা দূরের ওই বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহী নয়।
শিবালয় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যমুনা নদীতীরবর্তী তেওতা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে রয়েছে মাত্র চারটি বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ের একটি থেকে অপরটির দূরত্ব পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার, আর শিবালয় ইউনিয়নের চরাঞ্চলে কোনো বিদ্যালয়ই নেই।
শিবালয় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রণতোষ কুমার সেন বলেন, চরাঞ্চলে বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিশুর তুলনায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।
করুণ অবস্থা গাইবান্ধার চরে: গাইবান্ধার চরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। নেই শ্রেণীকক্ষ, চেয়ার-টেবিল ও বেঞ্চ। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান টিনের তৈরি। দু-একটি পাকা ভবন থাকলেও সেগুলো সংস্কারের অভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে। নদীভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়েছে অনেক বিদ্যালয় ভবন। এ ছাড়া অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে অনেক শিক্ষক বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হন না। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে বদলি শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া নেই বললেই চলে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, গাইবান্ধার সাত উপজেলার মধ্যে চারটি নদীতীরবর্তী। এগুলো হচ্ছে: গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ। চার উপজেলায় ১৩টি ইউনিয়নে ৫৪টি চর রয়েছে।
গাইবান্ধার এই ১৩ ইউনিয়নের চরাঞ্চলে মোট ৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৪৭টি সরকারি ও ৫১টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি। বিদ্যালয়গুলোতে মোট ১৫ হাজার ৮৪ জন শিক্ষার্থী থাকলেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৩৪৮ জন। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোরও একই চিত্র।
মোল্লারচর রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইকবাল হোসেন বলেন, বিদ্যালয়ের পাকা ভবন নেই। ২৮ হাত টিনের ঘরে কোনোমতো চারজন শিক্ষক দিয়ে ১০০ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হচ্ছে। বেঞ্চ না থাকায় মাটিতে চট বিছিয়ে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র রাশেদুল ও সুমন জানায়, বিদ্যালয়ে নলকূপ ও ল্যাট্রিন নেই।
সিধাই গ্রামের মেম্বার আবু হানিফ জানান, সড়ক যোগাযোগ না থাকায় শিক্ষকেরা এখানে বেশি দিন থাকতে চান না। দু-এক মাস থেকেই বদলি নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, দুর্গম চরের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে বেতনের অর্ধেক টাকা খরচ হয়। তাই বাধ্য হয়ে কয়েক মাস চাকরি করার পর অন্যত্র বদলি নিতে হয়।
ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের হেলেঞ্চা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি টিনশেড ঘর থাকলেও বেঞ্চ নেই। তিনজন শিক্ষক ১১১ শিক্ষার্থীকে মেঝেতে বসিয়ে পড়াচ্ছেন। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম বলেন, প্রয়োজনীয় বেঞ্চ ও ভবন নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম বলেন, চরাঞ্চলের বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষক চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানানো হয়েছে। বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে চেয়ার টেবিল বেঞ্চ কেনার জন্য। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়া গেলে এসব সমস্যার সমাধান হবে।
চরফ্যাশনের আট চরে স্কুলই নেই: ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার জনসংখ্যার তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নগণ্য। আটটি চরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নেই। ফলে এখানকার শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
চরফ্যাশনের মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সামালগীর আলম জানান, উপজেলার সিকদারের চর, চর ফারুকী, চর হাসিনা, চর স্টেফিন, জাহাজমারা, চর লিউলিন, চরহাদী, চর ফকিরা—এ আটটি চরে কোনো স্কুল নেই। ফলে চরাঞ্চলের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এসব চরে দ্রুত বিদ্যালয় স্থাপন প্রয়োজন।
ওপেন মিডিয়া লাইন
প্রথম আলোর সাথে সাথে আমরাও যথাযথ কতৃপক্ষে দৃষ্টি আকরশন করছি।
তারিখঃ মঙ্গলবার, ৮ মার্চ ২০১১
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।