জাপানে ভূমিকম্পের পর সুনামি

শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১১

৮.৯
মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। জাপানের সংস্থার মতে, এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮
৩৩
ফুট উচ্চতার ঢেউয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
১০০০
জনের মৃত্যু হয়েছে ভূমিকম্প ও সুনামিতে। নিখোঁজ রয়েছে ৩৪৯ জন
৪০
লাখ বাড়ি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে টোকিওতে। তারা এমন ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়নি

জাপানে শক্তিশালী ভূমিকম্পে দেয়াল ধসে পড়েছে পার্ক করা গাড়ির ওপর। গতকাল মিয়ামির মিতো শহর থেকে তোল
জাপানে শক্তিশালী ভূমিকম্পে দেয়াল ধসে পড়েছে পার্ক করা গাড়ির ওপর। গতকাল মিয়ামির মিতো শহর থেকে তোলা ছবি

জাপানের উত্তর-পূর্ব উপকূলে স্মরণকালের শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর ভয়াবহ সুনামি আঘাত হেনেছে। এ সময় প্রায় ৩৩ ফুট উচ্চতার ঢেউয়ে উপকূলীয় অঞ্চল তছনছ হয়ে গেছে। ভূমিকম্প ও সুনামিতে এক হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে ৫৩১ জন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রাণভয়ে হাজার হাজার মানুষ উপকূলীয় এলাকা থেকে সরে গেছে। সুনামির তোড়ে শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি জাহাজ ভেসে গেছে। ভূমিকম্পের কারণে টোকিওসহ বেশ কিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল, প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল, দক্ষিণ আমেরিকা ও রাশিয়ার কুড়িল দ্বীপে সুনামি-সতর্কতা জারি করা হয়। পরে মেক্সিকো উপকূলে ছোট আকারের সুনামি আঘাত হানে। প্রথমে বড় ধরনের সুনামি-সতর্কতা জারি করা হলেও আশঙ্কা কমে যাওয়ায় পর কিছু কিছু এলাকায় সতর্কতার মাত্রা কমিয়ে আনা হয়।
মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভে জানায়, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৯। তবে জাপানের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার মতে, ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮। স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার বেলা দুইটা ৪৬ মিনিটে ভূমিকম্প প্রথম আঘাত হানে। এরপর অন্তত ২০ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর মধ্যে কয়েকটি কম্পনের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৩। রাজধানী টোকিও থেকে প্রায় ২৫০ মাইল (৪০০ কিলোমিটার) দূরে ও ২০ মাইল (৩২ কিলোমিটার) গভীরে ভয়াবহ এই ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পবিদদের মতে, এটি ছিল জাপানে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। বিশ্বের ইতিহাসে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে এটি ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।
জাপানের এনএইচকে টেলিভিশনে দেখা যায়, সুনামির তোড়ে উপকূলীয় এলাকার ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা, গাড়ি, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, জাহাজ ভেসে যাচ্ছে। সুনামি আঘাত হানতে পারে সম্ভাব্য এমন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ গাড়িতে করে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছে। সুনামি উপদ্রুত এলাকাগুলোতে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এরই মধ্যে সরকারিভাবে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। উদ্ধারকাজের জন্য কিছু এলাকায় সামরিক হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছে।
জাপানের পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সুনামির তোড়ে শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি জাহাজ ভেসে গেছে। ওই জাহাজ বা যাত্রীদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছে, তা জানা যায়নি।
উপকূলীয় অঞ্চলে জাপানের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিকল হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। তবে জাপানের কর্মকর্তারা জানান, ওই অঞ্চলে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাও (আইএইএ) জানায়, জাপানের চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরাপদে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য সেনদাই শহরের দক্ষিণে ফুকুসিমা পরমাণু কেন্দ্রের আশপাশের এলাকা থেকে দুই হাজার লোককে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই এলাকায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পায়নি রাজধানী টোকিও। ভূমিকম্পের কিছুক্ষণের মধ্যে টোকিওর বেশ কিছু এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। আতঙ্কিত লোকজন বিভিন্ন ভবন থেকে নেমে পার্কসহ খোলা জায়গায় অবস্থান নেয়। ভূমিকম্পে রাজধানীর একটি মিলনায়তনের ছাদ ধসে ২০ জন আহত হয়। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে টোকিওর অন্তত ৪০ লাখ বাড়ি। টোকিওর অনেক বাসিন্দা জানায়, তারা জীবনে এত বড় ভূমিকম্প আর দেখেনি।
ভূমিকম্পে টোকিওর কাছে ইচিহারা শহরের একটি তেল শোধনাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংবাদ সংস্থা কিয়োদো জানায়, উত্তর-পূর্ব উপকূলে মিয়াগি শহরের সেনদাই বন্দরে ৩৩ ফুট উচ্চতার সুনামি আঘাত হানে। সুনামির তোড়ে অনেক গাড়ি সেনদাই বিমানবন্দরের রানওয়েতে আছড়ে পড়ে। ভূমিকম্পের কারণে সেনদাইয়ের কেন্দ্রস্থলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মিয়াগির ওনাগাওয়া পরমাণু কেন্দ্র টারবাইন ভবনেও আগুন লেগেছে বলে জানা গেছে। ভূমিকম্প ও সুনামিতে মিয়াগি অঞ্চলই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র বিস্তারিত জানা যাচ্ছে না।
ভূমিকম্পের পর জাপানের টোকিও ও উত্তরাঞ্চলের বুলেট ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। টোকিওতেও বেশ কিছু যান স্থগিত করা হয়। টোকিওর বাইরে নারিতা বিমানবন্দরে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য তা খুলে দেওয়া হয়।
জাতীয় পুলিশ সংস্থা থেকে জানানো হয়, এ পর্যন্ত ১৩৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। ৫৩১ জন নিখোঁজ রয়েছে। বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে আরও ৩৩০ জন। পুলিশ সংস্থার একজন মুখপাত্র জানান, ‘এই হিসাবে সেনদাই শহরের দুই থেকে তিন শ মৃতদেহের হিসাব ধরা হয়নি। এই দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেই হিসাব করার মতো সময় আমরা হাতে পাইনি।’ এদিকে পুলিশের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা কিয়োদো জানায়, শুধু সেনদাই শহরের দুই থেকে তিন শ মৃতদেহ দেখতে পাওয়া গেছে।
জাপানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা হিরোশি সাতো বলেন, সুনামিতে যোগাযোগব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপসহ সুনামিতে ভেসে আসা ধ্বংসাবশেষের কারণে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান জাতীয় টেলিভিশনে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমরা প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।’ তিনি এই দুর্যোগে সতর্ক ও শান্ত থাকতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী কান বলেন, ‘ভয়াবহ এই দুর্যোগে আমাদের কিছু পারমাণবিক স্থাপনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এসব স্থাপনা থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই।’
জাতিসংঘ গতকাল জানায়, জাপানে অনুসন্ধান ও উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক ৩০টি দল প্রস্তুত রয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়ক এলিজাবেথ বেরস জানান, ‘আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। উদ্ধার তৎপরতার জন্য আমরা সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত আছি।’
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সুসান হগ জানান, স্মরণকালের ইতিহাসে জাপানে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। ওই অঞ্চলে এত শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা কখনোই করা হয়নি। আর নথিভুক্ত করা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের মধ্যে এটিও স্থান পেতে পারে।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর শোক: জাপানে ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামির ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
শেখ হাসিনা জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতো কানের কাছে পাঠানো এক বার্তায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে গভীর শোক এবং দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জাপান সরকার সে দেশের জনগণের মিলিত সহযোগিতায় শিগগিরই এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, জাপানের জনগণ এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের প্রতি সমবেদনা জানান। বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস, ডেইলি মেইল।

0 আপনার মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।

Avro Keyboard - Unicode Compliant FREE Bangla Typing Softwareবাংলা লিখার সপ্টওয়্যার আভ্র ডাউনলোড করতে খানে ক্লিক করুন
 
 
 

বিশাল বাংলা

কম্পিউটার প্রতিদিন

রাজনীতি...

বিনোদন

খেলার খবর

অর্থ ও বাণিজ্য