ব্রায়ান চার্লস লারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের বরপুত্র। জন্ম ত্রিনিদাদের সান্তাক্রুজে, ১৯৬৯ সালের ২ মে। টেস্টে এক ইনিংসে ৪০০ রান করে অপরাজিত থাকা এই ক্রিকেটারকে সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লারা টেস্টে ৩৪টি সেঞ্চুরিসহ ১১ হাজার ৯৫৩ রান এবং ওয়ান ডে ক্রিকেটে ১৯টি সেঞ্চুরিসহ ১০ হাজার ৪০৫ রান করেছেন।
শৈশবে ত্রিনিদাদের পথে পথে খেলা হতো ক্রিকেট। আমার বাড়ির পাশের প্রতিবেশীরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকত। কখন না একটা বল জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে—এই আতঙ্ক ঘিরে রাখত তাদের। দিনভর খেলতাম আমি। যারা আমার সঙ্গে খেলত, তাদের অনেকেই সপ্তাহ খানেক ধরে বল করে যেত আমার বিপক্ষে। চার-পাঁচ ঘণ্টা টানা ক্রিজে থাকার পরও কখনো একঘেয়েমি চেপে ধরত না আমাকে।
আমি চেষ্টা করতাম শেষ পর্যন্ত ব্যাট হাতে মাঠে থাকতে। প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত খেলতাম বন্ধুদের সঙ্গে। পুরোটা সময় পর্যন্ত আমাকে যদি কেউ আউট করতে না পারত, তবে খেলা গড়াত পরের দিন পর্যন্ত। এটাই ছিল নিয়ম। শৈশবের সেই অনুশীলন এবং ইচ্ছাশক্তিই টেস্টে ৪০০ রান করে অপরাজিত থাকতে সাহায্য করেছে আমাকে। মনঃসংযোগে যেন চিড় না ধরে সে চেষ্টাই আমি করে যাই মাঠে থাকা অবস্থায়।
সপ্তাহ খানেক ধরে যখন বন্ধুরা আমাকে বল করত, তখন তাদের ক্লান্ত হতে দেখিনি কখনো। দেখিনি বিরক্ত হতে। বরং তারা আশাবাদী ছিল যে একটা সময়ে হাল ছেড়ে দেবই।
মাঠে ঘণ্টা দশেক টিকে থাকাটাই বড় কথা নয়। ধ্বংসস্তূপের মাঝ থেকে দলকে টেনে নেওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চরম বিপর্যয়ের মুখেও সাহস না হারিয়ে দলকে জিতিয়ে আনাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। একটা খেলা আনন্দের সঙ্গে শেষ হয় তখনই, যখন খেলার শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়া যায়। এই বিশ্বাস মনে রেখেই আমি মাঠে নামার চেষ্টা করি। অধিনায়ককে খুশি করার চেষ্টাটা থাকে আমার ভেতর সব সময়। একা কখনোই পুরো খেলার চেহারাটা বদলে দেওয়া যায় না। দলের সবার চেষ্টাতেই খেলায় জয় অর্জন সম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত অনেক সময়েই নিজের সেরাটা দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময়ই আমি খারাপ খেলে মাঠ ছেড়েছি।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপে আমার অবসর নেওয়ার খবর শুনে অনেকেই অবাক হয়েছে। অনেকেই অনুরোধ করেছে যেন আমি ফিরে আসি খেলায়। অনেক ক্রিকেটভক্ত মাঠে কিংবা টেলিভিশনে আমাকে না দেখতে পেয়ে হয়েছে হতাশ। তারা সব সময় বলত, খেলার জন্য যথেষ্ট যোগ্য এখনো আমি। এই বয়সেও অনেক কিছু দেওয়ার আছে আমার। তাদের ভালোবাসা ও বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করি আমি। সব সময়ই আমার ধারণা ছিল, শুধু দ্রুতগতিসম্পন্ন বোলাররাই শারীরিক কারণে দ্রুত খেলাটা ছেড়ে দেয়। কিন্তু এ ধারণা বদলে গেছে আমার। যেকোনো খেলোয়াড়েরই যেকোনো সময় শারীরিক সমস্যার কারণে খেলাটা ছেড়ে দিতে হতে পারে। আমি কখনোই নিজেকে বিশেষ কিছু ভাবিনি। আমি শুধু কাজ করে গেছি এবং সেই কাজকে উপভোগ করে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি বিদ্যালয়ে বা প্রথম বিভাগে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে করা নয়। আমি সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে গিয়ে ৩০০ রান করি। এই পাওয়া হুটহাট করে আসে না। আমি মনে করি, কেউ যদি নিজের কাজের প্রতিটা মুহূর্তকে আনন্দদায়ক করে তুলতে পারে এবং কাজকে উপভোগ করে কঠোর পরিশ্রম করে, তাহলে ফলাফল আসবেই। তখন সে কাজে মানুষ নিজেই অবাক হবে। পরিশ্রমের ফলাফল হিসেবে সব সময়ই ভালো কিছু পাওয়া যায়।
খেলার একদম শুরুর দিকে সবাই আমাকে বলত, ছেলেটি ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলছে। একদিন ও অনেক বড় তারকা হবে। আমি এসব নিয়ে ভাবিনি কখনো। জীবনের শেষ খেলা পর্যন্ত নিজেকে প্রস্তুত করার এক দারুণ প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম আমি। চেষ্টা করেছি নিজেকে শক্তিশালী করে তুলতে। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে শুরু করতাম খেলা। ১০০ নয়, শুরুতে ৫০ থেকে ৬০ রান তোলার চেষ্টা করতাম আমি। সেটা সম্ভব হলে আমি ছুটতাম ১০০-র দিকে। শেষ পর্যন্ত মাঠে থেকে বিপক্ষে দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টাটা চালিয়ে যেতাম সব সময়।
আমার মনে আছে, সিডনিতে প্রথম সেঞ্চুরি করার পর একজন বিখ্যাত খেলোয়াড় আমাকে বলেছিলেন, ‘রান করে যাও। থেমো না। এখন তোমার ব্যাটে রান আসছে, তুমি সেঞ্চুরি করছ কিন্তু যেকোনো সময় তোমার রানখরা শুরু হতে পারে। তাড়া করতে পারে দুর্ভাগ্য। তাই যতক্ষণ সুযোগ পাওয়া যায়, চালিয়ে যাও ব্যাট।’ সেই কথা মনে রেখে আমি সাহস পেয়েছি। মাঠে করেছি রান।
আমি কখনোই শত রান করা নিয়ে ভাবিনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাঠে থেকে আমি কখনো ক্লান্ত হতাম না। ভুগতাম না একঘেয়েমিতে। ইনিংস শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকার চেষ্টাটাই করে যেতাম আমি। বিপক্ষ দলের প্রধান ভাবনা হওয়াটা সহজ কথা নয়। এটা অনেক সময় ভালো খেলার ক্ষেত্রে কঠিন একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে এ ব্যাপারটাকে ভালো লাগত আমার সব সময়। উপভোগ করতাম আমি। এতে বেড়ে যেত নিজ দলের প্রতি দায়িত্ববোধ।
নিজের কাজে কখনোই অবাক হইনি আমি। কঠোর পরিশ্রম করে আমি যখন মাঠে নামতাম এবং রান পেতাম, তখন ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকই মনে হতো আমার। ভালো খেলার ইচ্ছা এবং চেষ্টাটা থাকলেই ভালো খেলা যায়।
নিজের সবচেয়ে সেরা সময়ের কথাটা জিজ্ঞেস করা হলে আমি বলব, ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমাদের জয়ের কথা। সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল তখন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট বোর্ডও তখন বেশ এলোমেলো। একটানা পরাজয়ের পর এই জয় সত্যিই অনেক সাহস জুগিয়েছে আমাদের। শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাওয়া সেই জয়ে আনন্দে কেঁদেছি আমরা।
অবসর নিয়েছি আমি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ক্রিকেটের বাইরের নানা কাজে। তবে ক্রিকেট ছাড়িনি। ক্রিকেট আমার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে পাশে থেকে সাহস জোগায় সব সময়ের জন্য। আমি ক্রিকেট ভালোবাসি। ভালোবাসি ক্রিকেট-পাগল মানুষদের।
যুক্তরাজ্যের দি ইনডিপেনডেন্ট (২০০৭) থেকে পাওয়া, একটি সাক্ষাৎকারের ইংরেজি ভাষ্য থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: কিঙ্কর আহস্ান
বিষয় সমুহ...
বিভাগীও শহর তথ্য কনিকা

আরো কিছু গুরুত্তপূর্ণ বিষয়...
আমি কখনো হাল ছাড়িনি
শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০১১অন্তরভুক্ত বিষয় ছুটির দিনে
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।