ক্যারিয়ার যখন ক্রিকেটে

শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০১১

ড্রয়িংরুমভর্তি লোকজন বিয়ের কথাবার্তা চলছে দুই পক্ষের মধ্যে গুরুগম্ভীর আলোচনার একপর্যায়ে কনের বাবা বরের বাবাকে বললেন, ‘তা ভাইজান, ছেলে কী করে?’ ছেলের বাবার শুকনো উত্তর, ‘আমার ছেলে ক্রিকেটার’ কনের বাবা যেন বুঝতে পারেননি আবারও একই প্রশ্ন, ‘বলছিলাম ছেলে কী করে?’ আবারও এল একই উত্তর, ‘ক্রিকেটার’ এবার একটু জোরের সঙ্গেই বললেন মেয়ের বাবা, ‘আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, ছেলে খেলার বাইরে আর কী করে?’
কোনো কৌতুক নয় বাস্তবের এই ঘটনা জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের আজ থেকে ১৫ বছর আগের

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলায় বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাস।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলায় বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাস।

এখন যদি সাকিব আল হাসানের বিয়ের ব্যাপারে কনের বাবা এমন প্রশ্ন করে বসেন, তাহলে তাঁর মাথা ঠিক আছে কি না তা নিয়েই হয়তো সন্দেহ দেখা দেবে সত্যিই তাই হাবিবুল বাশারের বিয়ের ওই ঘটনার পর মাঝখানে সময়ের ব্যবধান মাত্র দেড় দশক এটুকু সময়ের মধ্যেই কতটাই না হাওয়া বদলেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে! পেশাদারির মোড়কে ঘেরা মায়াবি স্বপ্নের এক ক্রিকেট দল—বাংলাদেশ ক্রিকেট খেললেই এখন মেলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা সিরিজ জিতলেই প্রধানমন্ত্রী হাতে তুলে দিচ্ছেন স্বপ্নের গাড়ির চাবি, ফ্ল্যাটের দলিল আইপিএলের প্রস্তাব পেলে তো কথাই নেই ওই ক্রিকেটারের তিন প্রজন্মের আর কিছু না করলেও চলবে আমাদের সাকিব এবার আইপিএলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন প্রায় তিন কোটি টাকায়
সেই দিন হয়তো বেশি দূরে নেই, যখন আপনি দেখবেন রাস্তার মোড়ে মোড়ে অথবা সূর্যের হাসি ক্লিনিকের বিজ্ঞাপনে লেখা—‘আপনার শিশুকে ছয়টি টিকা আর একটি ব্যাট হাতে তুলে দিন’ অথচ কয়েক বছর আগেও এমনটা কল্পনা করা যেত কি না, সন্দেহ ভারী ভারী বইয়ের বোঁচকা পিঠে আর পুরু পাওয়ারওয়ালা চশমা পরা জ্ঞানী-জ্ঞানী চেহারার ছেলেটাকে নিয়ে বাবা-মা স্বপ্ন দেখতেন, ‘আমার এই ছেলেকে হয় ডাক্তার, না হয় ইঞ্জিনিয়ার বানাতেই হবে’ তাই তো প্রতিটি পরিবারেরই এমন নিয়ম ছিল—সন্ধ্যার আগে আগেই ছেলেকে বাসায় ফিরতে হবে একটু দেরি করে ফিরলেই বাবার কড়া ধমক, ‘এতক্ষণ ছিলে কোথায়?’ মুখ কাঁচুমাচু করে ছেলেটা হয়তো বলবে, ‘ একটু ক্রিকেট খেলছিলাম, বাবা’ ব্যস! বাবার কঠিন নির্দেশ কাল থেকে আর ওসব ছাইভস্ম খেলতে হবে না কী হবে ওসব খেলে? বাবা হয়তো জানলেনই না তাঁর এই ছেলেই একটু আগে ২৮ বলে করেছে ৫২ রান সঙ্গে বল হাতে হ্যাটট্রিক করে দলকে জিতিয়ে তবেই বাড়িতে ঢুকেছে ছেলের এই প্রতিভা ওই কড়িকাঠেই বাধা পড়ে গেছে শুধুই সন্ধ্যার আঁধার নামার খানিক পরে ঘরে ঢোকার অপরাধে
ক্রিকেট নিয়ে এত মাতামাতি হয়তো হতো না, যদি ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় আইসিসি ট্রফি না জিতত বাংলাদেশ আকরাম খানের ট্রফি নিয়ে উল্লাস, বিমানবন্দর থেকে ফেরা, দলকে সংবর্ধনা হলুদ, লাল আর সবুজ জার্সি গায়ে মাথার ওপরে তুলে ধরা আকরাম খানের ট্রফির ওই ছবিটাই অনেক কিশোরের মনে সেদিন স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিল তবে সত্যিকার অর্থে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশের ক্রিকেট এত দূর পৌঁছেছে রকিবুল হাসান, গাজী আশরাফ হোসেন লিপুদের মতো ক্রিকেটারদের হাত ধরে তাঁদের হাত ঘুরেই ক্রিকেট বিবর্তনের শুরু এরপর একে একে বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি, বিশ্বকাপ খেলা, টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন, অনেক বাঁক পেরিয়ে আজকের এই উন্মাতাল বাংলাদেশ
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান খেলাকে ভালোবেসেই ক্রিকেটে এসেছেন জানালেন, ‘আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন ক্রিকেটকে ভালোবেসেই খেলেছি সম্মানের জন্য খেলেছি’ প্রথম খেলে তিনি কত টাকা পেয়েছিলেন জানেন? নিজেই জানালেন, ‘স্বাধীনতার পর আজাদ বয়েজের হয়ে খেলে মাত্র ৩০০ টাকা পেয়েছিলাম এখন যেটা ভাবাই যায় না’ ক্রিকেট নিয়ে এই যে মাতামাতি, সেটা ভালোই উপভোগ করেন তিনি, ‘ক্রিকেটের এই হাওয়া বদলটা খুবই ভালো লক্ষণ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই আসলে বাংলাদেশে এই উন্মাদনার শুরু এরপর ছেলেদের ক্রিকেট কোচিংয়ে ভর্তি করতে শুরু করলেন বাবা-মায়েরা
দেশ স্বাধীনের পরের কথা গাজী আশরাফ হোসেন তখন অনেক ছোট খালার হাত ধরে মাঠে যেতেন ক্রিকেট খেলা দেখতে সাদা পোশাক পরা খেলোয়াড়েরা তাঁকে খুব টানত স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে ক্রিকেটার হবেন কিন্তু ওই যে বাবা-মায়ের বকুনি! তাই তো শুধু পাড়া-মহল্লায় আর অলিতে-গলিতে ক্রিকেট খেলেই সন্তুষ্ট থাকতেন জানালেন, ‘আসলে ক্রিকেট খেলার প্রতি ভালোবাসা তখন থেকেই জন্মেছিল’ ওই সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, ‘আমি তখন অনেকটা এখনকার নেট বোলারদের মতো বোলিং করার সুযোগ পেতাম মাঝেমধ্যে অথবা ফিল্ডিংয়ের সুযোগ পেতাম কিংবা কোনো বাড়ির মধ্যে বল গড়িয়ে গেলে সেটা কুড়িয়ে আনতাম তবুও স্বপ্ন দেখতাম দ্বিতীয় বিভাগে খেলার’ এরপর তিনি ১৭ বছর বয়সে প্রথম খেলার সুযোগ পান কোথাও বেড়ানোর পরিবর্তে ক্রিকেট খেলতে মাঠে গিয়ে হাজির হতেন গাজী আশরাফ প্রথম খেলেন ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে ১৯৭৬-৭৭ সালের ঘটনা সেবার প্রথম বিভাগে শেষ চারটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু ক্রিকেট খেলে টাকা? সেটা তো স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি জানালেন, ‘ক্লাব থেকে আমাকে দিয়েছিল ৫০০ টাকা শার্ট-প্যান্ট বানানোর জন্য’ পরের বছর আবাহনীতে যোগ দিলেন সেবার পান ৩০০ টাকা সেই দিন আর এই দিন? তুলনা করতে গিয়ে বললেন, ‘এখন ছেলেরা স্বপ্ন দেখে জাতীয় দলে খেলার বাবা-মায়েরাও একই স্বপ্ন দেখেন ভালো চাকরি পাওয়ার বদলে তাঁরা ভাবেন, আহা, ছেলেটা যদি জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পায়!’ কারণটাও বললেন, ‘এখন ক্রিকেট এমন একটা পর্যায়ে উঠে গেছে, যেখানে শুধুই টাকা আর টাকা বড় বড় কোম্পানি স্পন্সর হচ্ছে ক্রিকেটাররা হচ্ছেন মডেল, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বিশ্বায়নের এই যুগে ক্রিকেটেই পেশাদারিত্ব সম্ভব হয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো দেশে
আম্পায়াররাও পেশা হিসেবে নিতে পারছেন দেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলামের (বুলবুল) মতো অনেকে কোচিংয়েও ঢুকে যাচ্ছেন
হাবিবুল বাশার বললেন, ‘আমাদের সময়ে ক্রিকেট খেলে টাকা আয় ভাবাই যেত না তবে আমি এসএসসি পাস করেই ঢাকায় চলে আসি সেটা ১৯৮৪-৮৫ সালের কথা প্রথম চার-পাঁচ হাজার টাকা পাই একটা কোচিং ক্যাম্প করে’ তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটের হাওয়া বদল হয়েছে ২০০০ সালের পর থেকে ক্রিকেটে টাকা-পয়সার ঝনঝনানির উদাহরণ হিসেবে আইসিএল বা আইপিএলের মতো টানলেন বাংলাদেশের লিগগুলোর কথা বললেন, ‘এখন এনসিএল ও পিসিএলের কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও পাচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা
জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার প্রতি মাসে ৯০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন সেই সঙ্গে ম্যাচ ফি, অন্যান্য পুরস্কার তো আছেই খেলে ক্রিকেটকে ধ্যান-জ্ঞান করতে তাই আর বাধা আছে কি?

0 আপনার মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।

Avro Keyboard - Unicode Compliant FREE Bangla Typing Softwareবাংলা লিখার সপ্টওয়্যার আভ্র ডাউনলোড করতে খানে ক্লিক করুন
 
 
 

বিশাল বাংলা

কম্পিউটার প্রতিদিন

রাজনীতি...

বিনোদন

খেলার খবর

অর্থ ও বাণিজ্য