‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায়, তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা’। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। রক্তে রাঙা নতুন সূর্য উঠেছিল সেদিন বাংলার আকাশে। আগের রাতের হত্যাযজ্ঞ আর সব মৃত্যুর ভ্রুকুটি এড়িয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে সেদিন জেগে উঠেছিল বাংলাদেশের প্রাণ। মৃত্যুর ভয় ভুলে গিয়ে রিকয়েললেস রাইফেল আর ট্যাংকের সামনে সাহসে বুক পেতে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাঙালি। সেইদিনই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। শুরু হয় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।
পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহুর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
বঙ্গবন্ধু তার ঘোষণায় বলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানার ইপিআর ঘাটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে। শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা, চট্রগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। বিশ্বের সকল জাতির কাছে সাহায্যের আবেদন করছি।
দেশ স্বাধীন করার জন্য তিনি শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। কোনো আপোষ নেই, জয় আমাদের হবেই। পরবর্তিতে চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
এছাড়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইপিআর এর ওয়ালেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ২৬ মার্চ থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সর্বস্তরের বাঙালি ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।
শনিবার মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় সূচনার দিন। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে শুরু হয় এ যুদ্ধ। এরপর টানা নয়টি মাস লড়ে বাঙালি। লক্ষ শহীদের রক্তে লাল হয় পথঘাট প্রান্তর। তারপর গোটা দেশকে ধ্বংসস্তূপ আর মৃত্যুকূপে পরিণত করে এক পর্যায়ে বাঙালির প্রাণপণ লড়াইয়ের মুখে পিছু হটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরাজয় ঘটে তাদের ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের। আর মৃত্যুকূপ ও ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের স্বাধীনতা দিবসটি অনেক কারণেই ভিন্ন। এবার স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি।
এবার ভিন্ন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হচ্ছে মহান স্বাধীনতা দিবস। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরেই আসছে। বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের এক বছর পূর্তি হয়েছে। এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাদের বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সরকার ও প্রধান বিরোধীদল উভয় পক্ষই চায়। একটি আন্তর্জাতিকমানের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সকলেরই বিচার হোক তা স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও চায় গোটা জাতি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল সেই রাতের পর যে সূর্য উঠেছিল তা স্বাধীনতার সূর্য হলেও দিনটি ছিলো শোকের। আর সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করেই বাঙালি উদ্দীপ্ত হয়েছিলো স্বাধীনতার সংগ্রামে। যে সংগ্রামে শহীদ হন ৩০ লক্ষ মানুষ। আর সম্ভ্রমহানি ঘটে দুই লক্ষাধিক মা-বোনের।
আত্মোৎসর্গকারী সেইসব মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে লাখো মানুষের ঢলে মুখরিত সাভারের স্মৃতিসৌধ। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ একে একে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা, বিদেশি কূটনীতিকরা আর সর্বসাধারণের দেওয়া ফুলে ফুলে সুরভিত স্মৃতিসৌধ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী তাঁর সহকর্মী জাতীয় নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও মানুষ ছুটবে তাদের সমাধিস্থল ও স্মৃতিস্তম্ভে। গোটা দেশ মেতে উঠবে স্বাধীনতার আনন্দ-উৎসবে। শহর-বন্দর-গ্রাম সব জায়গায় চলবে উৎসব। লাল সবুজের পতাকা শোভা পাবে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়, ভবন, বাড়ির ছাদ ও গাড়িতে।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ‘স্বাধীনতার এ মহান দিনে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করতে আমি দেশ-বিদেশে বসবাসরত সকল নাগরিককে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানাই।’
তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক এ দিনে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে; যার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থকসহ সকল স্তরের জনগণকে, যাঁদের অসামান্য অবদান ও সাহসী ভূমিকা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। আমি স্মরণ করছি শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে যাঁরা স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিভিন্ন পর্যায়ে এদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে সকলের অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমি দেশবাসীকে গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের উন্নয়ন বিরোধী মহলের অপপ্রয়াস সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। জাতির দাবি অনুযায়ী সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করেছে, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক ও চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি গণতন্ত্র ও সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে বানচাল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যে কোনো অপতৎপরতা রুখে দেওয়ার জন্য আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই।’
খালেদা জিয়া তার বাণীতে বলেন, একটি শোষন-বঞ্চনাহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এদেশের মানুষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। নানা কারণে আমরা সে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হইনি। বার বার স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী শক্তি আমাদের সে লক্ষ্য পূরণ করতে দেয়নি।
তিনি বলেন, আজও বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্র বানানোর গভীর চক্রান্ত চলছে। লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার অপতৎপরতায় লিপ্ত দেশি-বিদেশি চিহ্নিত মহল। সকল ষড়যন্ত্র চক্রান্ত প্রতিহত করে সকলকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শনিবার সরকারি ছুটি। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেল প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। দেশের হাসপাতাল ও জেলখানায় বন্দিদের উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় আয়োজন করা হবে বিশেষ প্রার্থনা।
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।