ওয়াকা ওয়াকা টাইম ফর আফ্রিকা!
ফেসবুকে কে যেন স্ট্যাটাস দিয়ে রেখেছে।
শাকিরার কোমরের দুলুনিতে আরও বেশি বিখ্যাত বিশ্বকাপ ফুটবলের থিম সং। তবে আপাতত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের থিম সং বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। এখন তো আফ্রিকারই অপেক্ষা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে দক্ষিণ আফ্রিকার। আগামী শনিবার মিরপুরে গায়ানা ফিরে এলেই কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ!
তা না হলেও সম্ভব। হল্যান্ড ম্যাচের আগেই সেই সমীকরণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আগামী পরশু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিলেই তো হয়। কিন্তু আজ যদি আয়ারল্যান্ড দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আরেকটি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে! তা হলে তো আবার জট পাকিয়ে যাবে। প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ভুক্ত বলে এ নিয়ে খুব একটা আলোচনাই হচ্ছে না।
বারেসির বিপক্ষে জোরালো এলবিডব্লুর আবেদন সাকিব আল হাসানের। তাঁকে শাহরিয়ার নাফীসের সমর্থন।
বিফলে যায়নি এই আবেদন। বাংলাদেশ দলটাও এগিয়ে চলেছে এই ঐক্য ও পারস্পরিক সমর্থনের শক্তিতে।
থাক, এসব তো আর বাংলাদেশের হাতে নেই। যা হাতে ছিল, হল্যান্ডকে হারিয়ে সেই কাজটা সেরে রাখলেন সাকিবরা। এখন দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারলে তো কোনো হিসাব-নিকাশেরই প্রয়োজন হবে না।
সময় কী দ্রুত বদলে যায়! নয় দিন আগেও এ কথা পড়ার পর আপনি বিদ্রূপের হাসি হাসতেন। এখন নিশ্চয়ই আপনারও মনে হচ্ছে, অসম্ভব কী, দক্ষিণ আফ্রিকাকে কি আমরা গত বিশ্বকাপে হারাইনি?
খেলাধুলায় এক সপ্তাহই কখনো কখনো এক বছর। ৫৮-বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ দল যেমন দশ দিন পরই বলতে পারছে—অন্যভাবে হলে হবে, না হলে আমাদের ভাগ্য তো আমাদের হাতেই।
চূড়ান্ত এই হিসাব-নিকাশের পথে একটা কাঁটা হয়ে ছিল হল্যান্ড। সেটিকে কাল উপড়ে ফেলল বাংলাদেশ, গায়ে কাঁটার ঘা প্রায় না লাগিয়েই। হ্যাঁ, ১৬০ রান তাড়া করতে একটু বেশি সময়ই লেগেছে। সুসময়ে যা হয়, এটিরও একটি ইতিবাচক দিক খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বলতে পারেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মহারণে নামার আগে ব্যাটসম্যানদের ভালো একটা ম্যাচ প্র্যাকটিস হয়ে গেল!
নেট রানরেটের কথা বলছেন? ওতে ভর দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া যাবে না—তা এমনই দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে এটি আর মাথাতেই রাখছে না বাংলাদেশ।
এমনিতে ওয়ানডে হিসেবে খুবই নিম্নশ্রেণীর একটা ম্যাচ হলো। ৮৭.৪ ওভারে ৩২৬ রান। রানরেট পৌনে চারের মতো। তার চেয়েও বড় কথা, প্রথম ইনিংস শেষ হওয়ার আগেই ম্যাচের ফলাফল একরকম জানা হয়ে গেছে সবার। প্রশ্নটা বাংলাদেশ জিতবে কি না নয়, কয় উইকেটে জিতবে।
ডাচ অধিনায়ক পিটার বোরেন ম্যাচের আগে খুব তেজি কণ্ঠে বলেছিলেন, কিসের সামনে পড়তে হবে, সেটি তাঁরা খুব ভালো জানেন। সেমতো প্রস্তুতিও নিয়ে এসেছেন। ম্যাচ শেষে সেই বোরেনই মিনমিন করে বললেন, ‘মনে হয়েছিল পারব, কিন্তু একদমই পারিনি।’
পারবেন কীভাবে? স্লো-লো উইকেটে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাই ২২ গজি আয়তক্ষেত্র সম্পর্কে বলছেন—‘খুব স্লো’ ‘এখানে শট খেলা কঠিন’। ডাচ ব্যাটসম্যানরা তো অকূল সাগরে হাবুডুবু খাবেনই। এমনিতেই এমন উইকেট, তার ওপর আবার বাঁহাতি স্পিনের ত্রিফলায় বিদ্ধ হওয়ার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। রাজ্জাক-সাকিব-শুভর ২৮ ওভারে ১০০ রানে ৫ উইকেট। স্পিনের ফাঁসে সারাক্ষণই হাঁসফাঁস করল ডাচরা।
তার পরও একজন পারলেন। রায়ান টেন ডেসকাট, যাঁকে বলতে পারেন গরিব দেশের রাজপুত্র। ডাকনাম টেনডো। টেন্ডুলকারের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন? ডেসকাট তো আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর টেন্ডুলকারই। বোলিং যোগ করলে শুধু আইসিসির সহযোগী সদস্যদের মধ্যে নয়, ওয়ানডে ক্রিকেটেরই সেরা অলরাউন্ডার। ব্যাটিং-গড় ৬৫.২২। বোলিং-গড় ২৩.৫০।
লড়াই যা করার ডেসকাটই করলেন। ৭১ বলে অপরাজিত ৫৩। বোলিংয়ে উইকেট নেই। তবে কভারে যে দুর্দান্ত ক্যাচটি নিয়ে সাকিবকে ফেরালেন, তা ভালোমতোই বুঝিয়ে দিল, সামনের আইপিএলেই ছয়টি ভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার কীর্তি করতে যাওয়ার রহস্যটা কী।
একটা রহস্যের অবশ্য কোনো উত্তর নেই। কাল শফিউলের উইকেটশূন্য থাকার ব্যাখ্যা হতে পারে একটাই—ক্রিকেট রহস্য করতে খুব ভালোবাসে। শফিউলের বলে ব্যাট থেকে প্রথম রান ১৮তম বলে। প্রথম স্পেল: ৬-৩-৭-০। ইনসুইং, আউটসুইং, স্লোয়ার, ইয়র্কার, বাউন্সার—ফাস্ট মিডিয়াম বোলিংয়ের এক অনুপম প্রদর্শনী বারবার চোখ কচলে দেখতে বাধ্য করল। শফিউলই বোলিং করছেন নাকি গ্লেন ম্যাকগ্রা!
শফিউলের জন্য এই বিশ্বকাপটা রংবেরঙের এক প্রজাপতি। ‘প্রজাপতি’ নামে নতুন এক ডেলিভারি আবিষ্কার করেছেন বলে দাবি বাংলাদেশের বোলিং কোচ ইয়ান পন্টের। স্লোয়ার বল, তবে সাধারণ স্লোয়ারের সঙ্গে পার্থক্য হলো, উইকেটে পড়ে তা নাকি প্রায় থেমে যায়। শফিউলের বোলিংয়ে অনেক বৈচিত্র্যের মধ্যে সেই ‘প্রজাপতি বল’ও ছিল কি না, প্রেসবক্স থেকে ঠিক বোঝা গেল না। তার পরও প্রজাপতির সঙ্গে তুলনাটা মাথায় এল, বাংলাদেশের তিন জয়েই তাঁর রং ছড়ানো দেখে।
আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জনতার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। কালও তাঁর অবদান প্রচ্ছন্নই হয়ে থাকল। স্কোর কার্ড মিতব্যয়ী বোলিংয়ের স্বীকৃতি দেবে। তবে স্পিনারদের সাফল্যে শুরুতে তাঁর অমন ‘শাইলক’ হয়ে যাওয়ার ভূমিকাটা পুুরোপুরি বলতে পারবে না।
কালকের ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার অবশ্য যোগ্য হাতেই উঠেছে। ডাকনাম সাগর, ইমরুল কায়েস সাগরপারের সাগরিকায় এই স্টেডিয়ামে বেরিয়ে এলেন তামিম ইকবালের ছায়া থেকে। বাংলাদেশের কেউ বিশ্বকাপে পরপর দুই ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেলেন এই প্রথম। আর সেই মাঠেই পরপর দুই ম্যাচে একইভাবে বোল্ড হলেন তামিম ইকবাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাও দ্যুতি ছড়ানোর পর। কাল জ্বলে ওঠার আগেই নিভে যাওয়া। বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিংয়ের সময় একটু পরপরই ‘তামিম, তামিম’ স্লোগান উঠল গ্যালারিতে। তামিম করলেন শূন্য।
তামিমের শূন্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ-বিপর্যয়। কিন্তু এ দিন সেটি গায়েই লাগল না। তবে বাংলাদেশের প্রথম পাঁচ বাঁহাতি পেরিয়ে ষষ্ঠজনকেও নামতে হলো। পরপর দুই বলে চার আর ছক্কা মেরে ম্যাচটা শেষও করলেন মুশফিকুর রহিম।
বাঁহাতিতে ঠাসা বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ, অথচ উইনিং শটটা এল এক ডানহাতির ব্যাট থেকেই। ওই যে ক্রিকেট রহস্য করতে বড় ভালোবাসে!
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।