যন্ত্রণা ভেসে গেল চোখের জলে

বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১১

ছেলের বয়স ৫৮ দিন। কিন্তু তার নাম রাখেননি মা সারজিন চৌধুরী। কি ভয়ংকর দুশ্চিন্তাতেই না ১০০ দিন কেটেছে তাঁর। স্বামী মাইন উদ্দিন সুদূর সোমালিয়ায় দুর্ধর্ষ জলদস্যুদের কাছে জিম্মি। অপহূত জাহাজ এমভি জাহান মণির দ্বিতীয় প্রকৌশলী তিনি। ছেলে তার বাবার মুখ দেখতে পারবে কি না, সন্দেহ ছিল। সারজিনের বিশ্বাস ছিল, স্বামী ফিরবেই। তিনি এসে নাম রাখবেন ছেলের। সে আশা বিফলে যায়নি।

কান্নায় ভেসে গেছে দুঃখ। জাহান মণির প্রথম প্রকৌশলী রোকসানা গুলজারকে (চশমা চোখে) জড়িয়ে ধরে কান্না�
কান্নায় ভেসে গেছে দুঃখ। জাহান মণির প্রথম প্রকৌশলী রোকসানা গুলজারকে (চশমা চোখে) জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা।

ছেলেকে নিয়ে সারজিন চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে এসেছিলেন গতকাল সোমবার। জীবন-মৃত্যুর অনিশ্চিত দোদুল্যমান পরিস্থিতি থেকে ফিরে এসে বাবা কোলে তুলে নিলেন নবজাতককে। প্রিয়জনের বাহুডোরে বাঁধা পড়েন জাহাজের অপহূত নাবিকেরা। আনন্দের অশ্রুতে ভেসে গেছে শত দিবসের নিদারুণ উদ্বেগ, বিনিদ্র রাতের দুঃসহ যন্ত্রণা।
কাল শাহ আমানত বিমানবন্দরে জাহান মণির নাবিকেরা ফিরে এলে স্বজনদের সঙ্গে মিলনে আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বেলা তিনটা ২৮ মিনিটে ওমান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে করে নাবিকেরা দেশে ফেরেন। এরপর প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তাঁদের ঘিরে চলতে থাকে স্বজনদের আনন্দের কান্না। অনেকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তাঁদের প্রিয়জন সত্যি সত্যি ফিরে এসেছে। বাবা-মা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন ছেলের মুখমণ্ডলে, স্ত্রী শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকেন স্বামীর হাত।
গত ৫ ডিসেম্বর ২৬ ব্যক্তিসহ জাহান মণিকে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা।
জাহাজের প্রথম প্রকৌশলী মতিউল মাওলা ও তাঁর স্ত্রী রোখসানা গুলজারকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন তাঁর তিন বোন লায়লা চৌধুরী, লায়লা রকিব ও লায়লা করিম। তাঁদের ভাই-ভাবির মাথা ও মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে দেখছিলেন, সত্যিই ফিরে এসেছেন তাঁরা!
জাহাজের ক্যাপ্টেন ফরিদ আহমেদের হাত ছাড়তেই চাইছিলেন না স্ত্রী শায়লা ফরিদ। টানা ১০০ দিনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যেতে চাইছেন স্বামীকে কাছে পেয়ে। বাবাকে আঁকড়ে ধরে ছিল ছেলে ফারহান আহমেদ। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও স্ত্রী-পুত্র এক মুহূর্ত সঙ্গছাড়া করেনি তাঁকে।
জিম্মিদশা থেকে ছেলেকে মুক্ত করতে জাহাজমালিক ও সরকারি নানা দপ্তরে সবচেয়ে বেশি দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন জাহান মণির ইঞ্জিন ক্যাডেট শাহরিয়ার রাব্বীর মা বিলকিস রহমান। গতকাল ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন তিনি। বিলকিস রহমানের উৎকণ্ঠা জানেন জাহাজমালিক মো. শাহজাহানও। তিনি বিলকিস রহমানকে বলছিলেন, ‘আপনার ছেলে কিন্তু ফিরে এসেছে। ও খুব ভালো।’
জাহান মণির চতুর্থ প্রকৌশলী তারিকুল ইসলামের স্ত্রী মাহফুজার কষ্ট ছিল আরও বেশি। স্বামী জলদস্যুর কবলে পড়ার সংবাদ পেয়ে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েছিলেন। সে সময় তাঁকে সাহস জোগাতেন তাঁর বাবা। মেয়েকে বলতেন, অবশ্যই তাঁর স্বামী ফিরে আসবে। এই দুঃসময়ে সেই বাবাও গত ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ছেড়ে চলে যান চিরতরে। বাবা মারা যাওয়ার পর সেই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন তিনি। স্বামীকে পেয়ে সে কথা বলতে বলতে অঝোরে কাঁদছিলেন মাহফুজা। বাবা নেই কিন্তু তাঁর কথা সত্যি হয়েছে।
মুক্তি পাওয়া নাবিকেরা তাঁদের জিম্মি থাকার দিনগুলোর কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, প্রতি মুহূর্ত তাঁদের কাটাতে হয়েছে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে। তাঁদের চোখের সামনেই অনেক জাহাজের নাবিক অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন। জলদস্যুরা তাদের সামনেই অন্য জাহাজের নাবিককে গুলি করে হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে। এসব দৃশ্য তাঁদের অত্যন্ত মানসিক পীড়ার মধ্যে ফেলেছিল। আবার প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ফিরতে পারবেন এমন আশা ক্ষীণ হয়ে আসছিল দিনে দিনে। প্রতিটি দিন মনে হতো, বছরের চেয়েও বেশি দীর্ঘ।
মুক্ত নাবিকদের স্বাগত জানাতে কাল আগে থেকেই বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাংসদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী, সাংসদ চেমন আরা তৈয়ব, সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাবিকদের স্বজনদের বলেন, ‘আপনারা যে ধৈর্য দেখিয়েছেন, তা অতুলনীয়। প্রথমবার বাংলাদেশি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ায় এখন আমরা নিরাপদে জাহাজ চলাচলের জন্য জলদস্যুবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।’ নাবিকদের আনন্দের কান্না দেখে একপর্যায়ে তিনিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

0 আপনার মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।

Avro Keyboard - Unicode Compliant FREE Bangla Typing Softwareবাংলা লিখার সপ্টওয়্যার আভ্র ডাউনলোড করতে খানে ক্লিক করুন
 
 
 

বিশাল বাংলা

কম্পিউটার প্রতিদিন

রাজনীতি...

বিনোদন

খেলার খবর

অর্থ ও বাণিজ্য