পাঁচ বছর আগে ঠিক এই দিনটির কথা। ২০০৬ সালের ১২ মার্চ। জোহানেসবার্গে বিশ্ব সাক্ষী হয়েছিল বিস্ময়ের। অস্ট্রেলিয়া ৪৩৪ রান করলে চোখ কপালে উঠে যায় সবার; সেটি টপকে দক্ষিণ আফ্রিকা জয় ছিনিয়ে আনলে বিস্ময় ছোঁয় আকাশ। সেই দলের ত্রিমূর্তি গ্রায়েম স্মিথ, জ্যাক ক্যালিস এবং এবি ডি ভিলিয়ার্স কালও ছিলেন প্রোটিয়া একাদশে। ভারতীয় ইনিংসের ওভার দশেক বাকি থাকতে কি সেটি নিয়েই মাঠে আলোচনা করছিলেন তাঁরা?
শ-চারেক রান তাড়া করতে হলে সেই ইতিহাসের চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কী হতে পারে!
সোচিন টেন্ডুলকার
কিসের কী! ৪০০ দূরের কথা, ব্যাটসম্যানদের আত্মাহুতির মিছিলে ভারত ৩০০ পর্যন্ত করতে পারল না। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য ২৯৭ রানের টার্গেটও বা কম কিসে! বিশেষত আগের ম্যাচে যারা ১৭২ রান ছুঁতে পারেনি, যাদের পিঠে লেপ্টে আছে 'চোকার' তকমা_তাদের জন্য এটি তো পর্বতসম। কিন্তু কী অবিশ্বাস্য দক্ষতাতেই না সেসব ঝেড়ে ফেলল স্মিথের দল! ভারতকে হতভম্ব করে; আরেকবার ক্রিকেটবিশ্বের বিস্ময়ের পারদ চড়িয়ে।
এই বিশ্বকাপ একের পর এক উপহার দিচ্ছে ধ্রুপদী সব লড়াই। ভারত-ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড-ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার পর পরশুর বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড। এগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতোই এক ম্যাচ হলো কাল নাগপুরে। প্রায় পুরোটা সময় যারা ছিল ব্যাকফুটে, এমনকি শেষ ওভারেও যাদের ওপর বাজি রাখার খুব বেশি লোক ছিল না_শেষ হাসি যে সেই প্রোটিয়াদেরই! পরতে পরতে অনিশ্চয়তায় পসরা সাজানো এই ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত জয়গান গাইল ক্রিকেট সৌন্দর্যের।
১০০ ওভারের এ ম্যাচের বাকি সব আলোচনা পরে। বহুকাল পর যখন এ নিয়ে কথা হবে, শুরুটা হবে তখন শেষ থেকে। শেষ ওভারে জয়ের জন্য ৩ উইকেট হাতে নিয়ে প্রোটিয়াদের চাই ১৩ রান। ৬ বলে ১৩ রান যে কখনো হয়নি, তা নয়। কিন্তু 'চোকার' প্রোটিয়ারা সেটি করতে পারবে, এমন বিশ্বাস করার লোক ছিল না বললেই চলে। আশীষ নেহরার করা প্রথম বল রবিন পিটারসনের ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে চার। এর পরও গ্যালারির উন্মাতাল গর্জন, 'ইন্ডিয়া জিতেগা'। সেখানে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে আসে পরের বলে। লং অন-মিড উইকেটের মাঝ দিয়ে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছক্কাটি হাঁকান পিটারসন। হঠাৎই সমীকরণ হয়ে যায় ৪ বলে ৩ রানের। পরের বল ফাইন লেগে ঠেলে ২ রান। নাহ্, শচীন টেন্ডুলকারের সরাসরি থ্রোতে যে স্ট্যাম্প ভেঙে গেল! কিন্তু আগেই ক্রিজের ভেতর পেঁৗছে যান পিটারসন। কাভার বাউন্ডারির ওপারে বল পাঠিয়ে পূর্ণতা দেন রূপকথার। হঠাৎই স্থিরচিত্রে পরিণত হওয়া ভারতীয় ক্রিকেটার-দর্শকদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকানদের বুনো জয়োল্লাস; ভারতকে হারানোর। চোকার তকমা খসিয়ে দেওয়ারও নয় কি!
দিনের শুরুটা হয়েছিল শচীন টেন্ডুলকারের ছন্দময়তা আর বীরেন্দর শেবাগের রুদ্রমূর্তিতে। ডেল স্টেইন-মরনে মরকেলের ভাগ্যটাই খারাপ। বিশ্বসেরা দুই ওপেনিং ব্যাটসম্যানের সঙ্গে লড়ে গেছেন তাঁরা সমানে সমান। বাউন্ডারির জবাব দিয়েছেন বাউন্সারে। চার হওয়ার পরের বলটিই হয়তো ছোবল হেনেছে প্যাডে কিংবা ছুঁয়ে গেছে ব্যাটের কানা। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা যে মুখ ফিরিয়ে ছিল! উইকেট পাবেন কিভাবে! উল্টো টেন্ডুলকার-শেবাগ সেটল হয়ে বাড়িয়েছেন দুর্দশা। ফল? মাত্র ১৭.৪ ওভারে ১৪২ রানের ওপেনিং জুটি।
শেবাগ (৬৬ বলে ৭৩) গেলেন, গাম্ভীর এলেন। স্কোরবোর্ডের চলনে তাতে কোনো হেলদোল হলো না। সেই বলের সঙ্গেই তো তাল মিলিয়ে ছুটছিল রানের চাকা। দ্বিতীয় উইকেটে টেন্ডুলকার-গাম্ভীর যোগ করলেন ২২ ওভারে ১২৫ রান। হাফ সেঞ্চুরি হয়ে গেছে গাম্ভীরের। টেন্ডুলকারের আরেকটি হীরণ্ময় সেঞ্চুরি। সুনামি যেমন ভাসিয়ে নিয়েছে জাপানকে, ভারতের প্রথম তিন ব্যাটসম্যান তেমনি প্রোটিয়াদের। একটু পার্থক্য আছে অবশ্য। সুনামি কোনো সুযোগ দেয়নি, তবে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা দিয়েছেন। তা কাজে লাগিয়ে শেষ বেলায় প্রবল বিক্রমে ঘুরে দাঁড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা। টেন্ডুলকারকে (১০১ বলে ১১১) ফিরিয়ে যে ধসের সূচনা করেছেন মরকেল, স্টেইনের গতিঝড়ে পূর্ণতা পায় তা। ৯.৪ ওভারে ৫০ রানে ৫৪ উইকেটে বিশ্বসেরা এই পেসারের। সবগুলো শিকারই শেষ ১৬ বলে মাত্র ৪ রান দিয়ে! ভারত ৫৫ বলে মাত্র ২৯ রান যোগ করতেই খুইয়ে বসে শেষ ৯ উইকেট। ৪০০-র সম্ভাবনা জাগানিয়া ইনিংস কফিনে ঢুকে যায় ৪৮.৪ ওভারে মাত্র (!) ২৯৬ রানে অলআউট হয়ে।
লক্ষ্য ওভারপিছু প্রায় ৬ রানের। ধুন্ধুমার শুরুটাই তাই প্রত্যাশিত। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের অর্ধেকটা এগিয়েছে অদ্ভুতুড়ে গতিতে। কোনো তাড়াহুড়া নেই, নেই বাউন্ডারির ছটফটানি। ২৫ ওভারে ১ উইকেটে ১১৫ রান আবার বলছিল না যে লক্ষ্যটা ২৯৭ রানের। বাকি ২৫ ওভারে যে চাই আরো ১৮২ রান। তবে হাতে ৯ উইকেট ছিল বলে পেঁৗছানো যাচ্ছিল না কোনো অনুসিদ্ধান্তে। যদি জিতে যায়, জয়ধ্বনি উঠবে প্রোটিয়াদের পরিকল্পনার। হেরে গেলে মনে হবে, শেষের জন্য বড্ড বেশি কাজ বাকি রেখেছিল তারা। শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো দ্বিতীয়টির। অসাধারণ এক জয়ে ইতিহাসকে কবরচাপা দিল গ্রায়েম স্মিথের দল।
ভারতীয় ব্যাটিংয়ের শেষ দিক থেকেই বোঝা যাচ্ছিল উইকেট আর ব্যাটিং স্বর্গ নেই। তবে বোলিং স্বর্গেও রূপান্তর ঘটেনি। বল একটু থেমে যাচ্ছিল, এই যা। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনিংটা হলো রয়ে-সয়ে। ৮.৩ ওভারে ৪১ রান। গ্রায়েম স্মিথ (১৬) ফিরে যাওয়ার পর আরো ধীর হয়ে যায় রানের চাকা। দাবি যেখানে রোলস রয়েসের, সেখানে ঠেলাগাড়ির মন্থরতা। হাশিম আমলার সঙ্গে জ্যাক ক্যালিসের ১৮.৫ ওভারে ৮৬ রানের জুটি এমনিতে হয়তো খারাপ নয়। কিন্তু কাল ম্যাচের চাহিদার সঙ্গে ঠিক যেন মিলছিল না।
আস্কিং রেট যখন ক্রমে জোয়ালের মতো কেটে বসছিল প্রোটিয়াদের কাঁধে, তখনই আমলা (৭২ বলে ৬১) আউট। গত দুই ম্যাচ উইকেটশূন্য হরভজন সিংয়ের মহামূল্য শিকার। রানখরায় ভোগা ক্যালিস অবশ্য খেলছিলেন আস্থার প্রতীক হয়ে। টুর্নামেন্টে হাজার রান পূর্ণও করে ফেলেন তিনি। এবারের আসরের প্রথম ফিফটিও। শেষ ১৫ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবেশ করে ১২৭ রানের প্রয়োজনীয়তা সঙ্গী করে, ৮ উইকেট হাতে নিয়ে।
ম্যাচে তখনো দু-দলই আছে। হয়তো পাল্লা খানিকটা ঝুঁকে স্বাগতিকদের দিকে। জহির খানের করা ওই ৩৬তম ওভারে ক্যালিস (৮৮ বলে ৬৯) আউট হলে আরো ঝুঁকে পড়ে তা। প্রথমে এলবিডাবি্লউর আবেদন, আম্পায়ার খারিজ করে দেওয়ার পর রিভিউয়ের আবেদন, সেটি স্টাম্পে লাগছে দেখেও ২.৫ মিটারের বাইরে প্যাডে লাগায় বেঁচে যান ক্যালিস। কিন্তু পরের বলেই রান আউটের আত্মহত্যা। পরের ওভারেই পাওয়ার প্লে নিয়ে নেন ডি ভিলিয়ার্স ও জ্যাঁ পল দুমিনি। চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে গ্যালারির দর্শকদের বিরতিহীন উৎসব উদ্যাপনে যতিচিহ্ন টেনে দেন তাঁরা। হরভজনকে রিভার্স সুইপের ঔদ্ধত্যে বাউন্ডারি মেরে ৩৮ বলে হাফ সেঞ্চুরি হয় এবি ডি ভিলিয়ার্সের। ঠিক পরের বলেই মিড উইকেট বাউন্ডারি লাইনে বিরাট কোহলির অসাধারণ ক্যাচ হয়ে যান। সঙ্গে কি নিভে যায় না প্রোটিয়াদের আশার প্রদীপও! পাওয়ার প্লের ৫ ওভারে ৫২ রান নিলেও ওই উইকেটটি স্মিথের দলের বুকে বেঁধে শেল হয়ে।
শেষ ৯ ওভারে চাই ৭২ রান, হাতে ৬ উইকেট_এমনিতে অসম্ভব কোনো সমীকরণ নয়। কিন্তু প্রোটিয়াদের মিডল ও লোয়ার মিডল অর্ডারের ক্ষুণ্নশক্তির কথা সবার জানা। জানা চাপের মুখে তাদের ভঙ্গুরতার ইতিহাসও। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে সম্ভাবনার বাতিগুলো নিভে আসছিল ক্রমে। সমান্তরালে ক্রমে উজ্জ্বল হচ্ছিল ভারতের স্বপ্নের ঝাড়বাতি। তোপের মুখে থাকা হরভজনই হয়ে ওঠেন ধোনির তুরুপের তাস। আমলা, ডি ভিলিয়ার্সের পর দুমিনিকেও (২০ বলে ২৩) ফেরান তিনি। পরের ওভারে ফন উইককে (৫) মুনাফ এলবিডাবি্লউ করলে গ্যালারিতে সমুদ্রের গর্জন। ম্যাচ তো পকেটে পোরা হয়ে গেছে।
নাটকের শেষাঙ্ক তখনো বাকি। হাতে ৪ উইকেট নিয়ে শেষ ৫ ওভারে চাই ৪৬ রান। ৩ ওভারে ৩১। মুনাফ প্যাটেলকে পরপর দুই বলে চার-ছয় মেরে ইয়োহান বোথা প্রয়োজনীয়তা নামিয়ে আনেন ১৪ বলে ১৮ রানে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচ তখন প্রোটিয়াদের দিকে। পরের বলে লং অনে বদলি ফিল্ডার সুরেশ রায়নার অসাধারণ রানিং ক্যাচে শেষ হয় বোথার ১৫ বলে ২৩ রানের মিনি ঝড়। শেষ ২ ওভারে তখনো চাই ১৭ রান। রান আউটের নিশ্চিত এক সুযোগ মিস করে ভারত। কিন্তু জহির খানের অসাধারণ ওভার থেকে ৪ রানের বেশি নিতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। শেষ ওভারে ১৩ রানের প্রয়োজনীয়তার সামনে দাঁড় করিয়ে তো জয়ের কাজটি এক প্রকার সেরেই রেখেছিল ভারত। কিন্তু খেলাটির নাম যে ক্রিকেট। তাই তো শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার অমন অসাধারণ জয়।
মাঠের মধ্যে স্মিথ-পিটারসন-প্লেসি-বোথাদের জয়োল্লাসের মধ্যে একটা দৃশ্য হয়তো চোখে পড়েনি অনেকের। মাথা নিচু করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন শচীন টেন্ডুলকার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেও দলকে দেখেছেন টাই করতে। কাল আরেকটি সেঞ্চুরির পর হার। বিশ্বকাপের দুঃখী রাজকুমারের জন্য শেষ আসরটাও তাহলে ট্র্যাজিক হয়েই থাকবে!
ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা স্কোরকার্ড
টস : ভারত
ভারত রান বল ৪ ৬
শেবাগ বোল্ড প্লেসি ৭৩ ৬৬ ১২ ০
টেন্ডুলকার ক ডুমিনি ব মরকেল ১১১ ১০১ ৮ ৩
গাম্ভীর ক ক্যালিস ব স্টেইন ৬৯ ৭৫ ৭ ০
পাঠান ক স্মিথ ব স্টেইন ০ ২ ০ ০
যুবরাজ ক বোথা ব ক্যালিস ১২ ৯ ০ ১
ধোনি অপরাজিত ১২ ২১ ০ ০
কোহলি ক ও ব পিটারসন ১ ৩ ০ ০
হরভজন বোল্ড স্টেইন ৩ ৯ ০ ০
জহির ক মরকের ব পিটারসন ০ ৩ ০ ০
নেহরা ক স্মিথ ব স্টেইন ০ ৩ ০ ০
প্যাটেল বোল্ড স্টেইন ০ ১ ০ ০
অতিরিক্ত (লেবা-২, ও-১২, নো-১) ১৫
মোট : (৪৮.৪ ওভার, অলআউট) ২৯৬
উইকেট পতন : ১/১৪২, ২/২৬৭, ৩/২৬৮, ৪/২৬৮, ৫/২৮৩, ৬/২৮৬, ৭/২৯৩, ৮/২৯৪, ৯/২৯৬।
বোলিং : স্টেইন ৯.৪-০-৫০-৫, মরকেল ৭-০-৫৯-১, ক্যালিস ৮-০-৪৩-১, পিটারসন ৯-০-৫২-২, ডুমিনি ৩-০-২৯-০, বোথা ৯-০-৩৯-০, প্লেসি ৩-০-২২-১।
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।