৬০০ বলের খেলা। শেষ বলে গিয়ে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে কতবার। কাল হলো মাত্র ৬৭ বলে! নিউজিল্যান্ড ইনিংসের শেষ ২৪ আর পাকিস্তান ইনিংসের প্রথম ৪৩ বলে। ৪৬ ওভার শেষে যে দলের রান ৬ উইকেটে ২১০, বাকি ৪ ওভারে ৪০-৫০ রান করলেই তাদের সন্তুষ্ট থাকার কথা। নিউজিল্যান্ড করল ৯২। ৩০২ রান অনেক দিনই ওয়ানডেতে আর পর্বতসম নয়। কিন্তু ৭.১ ওভারে ২৩ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারানো দলের কাছে তো সেটা এভারেস্ট!
অনুমিতভাবেই সেই এভারেস্টের নাগাল পায়নি পাকিস্তান। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ৪১.৪ ওভার খেলে ম্যাচ হেরেছে ১১০ রানে। তবে ম্যাচ আসলে শেষ আরও অনেক আগেই। লক্ষ্য যখন ৩০৩, ৪৫ রানের মধ্যে প্রথম ৫ ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ফেললে ম্যাচের কী-ই বা আর বাকি থাকে? হ্যাঁ, যদি উমর আকমল, শহীদ আফ্রিদি বা আবদুল রাজ্জাকের মতো ব্যাটসম্যান থাকে, তবে আশা থাকে বিনোদনের। আফ্রিদি শুরু করেছিলেন, বরাবরের মতোই অঙ্কুরে শেষ। উমরের মন বিনোদনের চেয়ে যৌক্তিকভাবেই বেশি ছিল ইনিংস গড়ার দিকে। বিনোদন কিছু পাওয়া গেল রাজ্জাক-গুলের ৫০ বলে ৬৬ রানের জুটিতে। বহুদিন পর একটু বেশি সময় ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে রাজ্জাক প্র্যাকটিস ভালোই করেছেন। ম্যাচে পাকিস্তানের প্রাপ্তি বলতে এটুকুই।
তাঁর ব্যাটে উঠল ঝড়।
১৩১ রানের ইনিংস খেলে পাকিস্তানের ওপর বড় রানের বোঝা চাপালেন নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যান রস টেলর
পাল্লেকেলের অভিষেক ওয়ানডেটা তাই স্মরণীয় কিছু হলো না। তবে স্মরণীয় একটা ইনিংস ঠিকই পেয়েছে ক্যান্ডির দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেন্যু। অন্তত রস টেলর এই দিনটিকে কখনোই ভুলবেন না। তাঁকে মনে করা হয় তাঁর প্রজন্মের নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। সেই প্রমাণও অনেকবার দিয়েছেন, এ জন্যই দলের সহ-অধিনায়ক তিনি। বিশ্বকাপের পর ভেট্টোরির উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়েও সবচেয়ে এগিয়ে। কিন্তু ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতার বড্ড অভাব। সেই অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল গত কিছুদিনে। এতটাই যে, প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল একাদশ জায়গা নিয়ে। নিউজিল্যান্ডের সাম্প্রতিক দুর্দশার দায়ও অনেকটা পড়েছিল তাঁর কাঁধে। সব ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্য বেছে নিলেন ২৭তম জন্মদিনকে। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংস তো বটেই, নিঃসন্দেহে সেরা ইনিংসও।
সেঞ্চুরির পর উদ্যাপনই বলছিল এই ইনিংসটা তাঁর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে পুরো ইনিংসটা খেয়াল করলে। শুরুতে ছিলেন নড়বড়ে। রানের খাতা খোলার আগেই ব্যাটের কানা নিল শোয়েব আখতারের বল। ক্যাচ ধরা বাদ দিয়ে স্লিপে ইউনুস খানের দিকে তাকিয়ে কামরান আকমল। এক বল পরে যে ক্যাচটি ছাড়লেন, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভাবতে পারে, এই দুটি টেলরকে কামরানের জন্মদিনের উপহার। কিন্তু এমন ব্যাখ্যাতীত ক্যাচ ফেলার কাজটা ‘সিনিয়র’ আকমল কিন্তু মোটামুটি নিয়মিতই করে আসছেন। ক্যাচ মিসের কোনো হিসাব রাখা হয় না। তবে কোনো ঝুঁকি না নিয়েই বলা যায় এখানে কামরান অপ্রতিদ্বন্দ্বী!
টেলর কিন্তু বেশির ভাগ দিনের মতো ছটফট করে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসেননি। উইকেটে পড়ে থেকেছেন। স্বভাববিরুদ্ধ ধীরগতিতে এসেছে প্রথম ফিফটি (৭৯ বলে), তবু অস্থির হননি। ১৪তম ওভারে দুটি চারের পর আরেকটি চার মেরেছেন ২০তম ওভারে, চতুর্থটি ৩০তম ওভারে। এর পর ৪৫ ওভারের আগে আর কোনো চারই নেই! রানে ফেরার জন্য চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞাটা ফুটে উঠেছে এতেই। অপেক্ষা করেছেন সময় আসার। ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতেও এসেছে মাত্র ৩৭ রান। তবে সময়মতো দেখিয়েছেন নিজের বিধ্বংসী দিকটা। শেষ ৬ ওভারে তাই ১১৪। ওরামের সঙ্গে সপ্তম উইকেট জুটিতে ২২ বলে ৮৫! এর মধ্যে ৫৫-ই টেলরের ব্যাট থেকে, অবিশ্বাস্য শোনাবে, মাত্র ১৩ বলে! শোয়েবের এক ওভারে ২৮ রান নিয়ে নিউজিল্যান্ডের রেকর্ড গড়লেন, এক ওভার পরই রাজ্জাকের ওভারে ৩০ নিয়ে রেকর্ড লেখালেন নতুন করে। অসংখ্য ফুলটস, লেংথ বল করে যথাসাধ্য ‘সহায়তা’ করেছেন শোয়েব, রাজ্জাক, রেহমানরাও।
নিউজিল্যান্ডের ইনিংসটা এতটাই টেলরময় যে, হারিয়েই যাচ্ছেন মার্টিন গাপটিল। ‘প্রতিভার অপচয়কারী’ থেকে নাম কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সম্প্রতি। আগের ম্যাচে অপরাজিত ৮৬, কাল করলেন ৫৭। টানা চার ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ডটাকে একার করে নিতে পারেননি আফ্রিদি, কাল পেয়েছেন শুধু ওই গাপটিলের উইকেটটিই।
বোলিংয়ের শেষ ৪ ওভারের দুঃস্বপ্ন নিশ্চয়ই ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, দুঃস্বপ্ন তাই দীর্ঘ হলো ব্যাটিংয়েও। ১ উইকেটে ২৩ থেকে ৭ বলের মধ্যে ৪ উইকেটে ২৩! কৃত্রিম আলোয় পাল্লেকেলের উইকেটের আচরণ নিয়ে কৌতূহল ছিল অনেকেরই। বোলাররা বাড়তি কোনো সুবিধা পেয়েছেন বলে মনে হয়নি। বারবার আড়াআড়ি খেলে বরং সর্বনাশ ডেকে এনেছেন পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরাই। ইনিংসের শুরুতে একটা ক্যাচ নিতে গিয়ে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়লেন ভেট্টোরি। কিন্তু বোলিংয়ে প্রয়োজনই হলো না কিউই অধিনায়ককে।
এই ম্যাচে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল আসলে পাকিস্তানই। ইতিহাস বলে টানা ধারাবাহিকভাবে ভালো তারা কখনোই খেলতে পারে না। গ্রুপের প্রথম তিন ম্যাচেই জয়ী দলটার জন্য কালকের ম্যাচ তাই ছিল টেম্পারামেন্টের পরীক্ষা। আফ্রিদির দল প্রমাণ করল তারা পাকিস্তানই আছে!
তারিখঃ বুধবার, ৯ মার্চ ২০১১,
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।