২৫ জানুয়ারি ২০১১
অফিসের কাজে মাসকাট স্কয়ারে আছি। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে এক কাপ কফি নিয়ে অভ্যাসমতো টেলিভিশনে নিউজ চ্যানেলটা চালিয়ে সোফায় এসে বসলাম। চোখ আটকে গেল ব্রেকিং নিউজে, ‘ইজিপ্ট প্রোটেস্টস’। টেলিভিশনের স্ক্রিনে তখন উত্তাল কায়রো আর ততোধিক উত্তাল আমার অতি পরিচিত তাহরির স্কয়ার। মাসকাট এসেছি ২৩ জানুয়ারি। সঙ্গে সহকর্মী আলেকজান্দ্রা। সারা পথ দুজনে তিউনিসিয়া নিয়ে আলোচনা করেছি। আঞ্চলিক অফিস থেকে যে কয়টা দেশে আমরা কাজ করি, তিউনিসিয়া তার মধ্যে একটি। আমাদের অতি পরিচিত আর প্রিয় এই শহর কায়রোও যে কখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল, বুঝতে পারিনি।
কর্মসূত্রে মিসরে থাকি আমি প্রায় চার বছর আর ও নয় বছর। আমাদের এই আঞ্চলিক অফিসে অনেক মিসরীয় কাজ করে—ছেলে, মেয়ে, বিভিন্ন বয়সী। আমরা কখনোই ওদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক আলোচনা শুনিনি। কেমন একটা রাখ রাখ ঢাক ঢাক ব্যাপার।
বিক্ষুব্ধ মিসরীয়দের এই আন্দোলন আমাকে ভাবিয়ে তুললেও আলেকজান্দ্রা উৎফুল্ল: ‘ভাবতে পারো, একটা ইয়ং জেনারেশন এই প্রতিবাদে মুখর হয়েছে? তুমি তো ফেসবুকের সমালোচনা করো অথচ দেখো, এই ফেসবুকের মাধ্যমেই এরা এত সংঘবদ্ধ হয়েছে।’
এর মাঝেই কায়রো থেকে ফোনের পর ফোন। সহকর্মীরা, অফিসের নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন। একই কথা, ‘তোমরা ভেবো না। দ্রুত সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমার স্বামী ফিরোজ আমাদের কনিষ্ঠা কন্যা আয়ুশাকে নিয়ে কায়রোতে আছে। জানাল, ওরা ভালো আছে। বলল, আমাদের পরিচিত অনেক মিসরীয় তাহরির স্কয়ারে আছে।
উত্তাল তাহরির স্কয়ার, উত্তাল মিসর
আমি একবার টেলিভিশনে বিবিসির লাইভ সম্প্রচার দেখি আর সেলফোনে সেই ছবির লাইভ আওয়াজ শুনি। আমার হাত-পা ঝিমঝিম করছে।২৬ জানুয়ারি
সকালে অফিসে যাই। কাজকর্ম করি আর একটু পর পর ইন্টারনেটে কায়রোর খবর নিই। টেক্সট মেসেজে ভরে উঠে সেল ফোন।
২৭ জানুয়ারি
আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ফিরোজ বলল, বাসার জন্য ও কিছু খাবারদাবার কিনে রেখেছে। কী হতে কী হয়। জানাল, আয়ুশা স্কুলে যাচ্ছে না। স্কুল বন্ধ আপাতত। এদিকে মাসকাটে আমাদের রুটিন একই থাকে। কাজকর্ম করি সারা দিন। সন্ধ্যায় ফিরে আমি ও আলেকজান্দ্রা টেলিভিশন খুলে বসি আর নানা রকম সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করি।
২৮ জানুয়ারি
ইন্টারনেট, সেলফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। দূরবার্তার যে টুকরো কথাগুলো আলেকজান্দ্রা আর আমাকে পরিবার-পরিজনের কাছে নিয়ে যেত, তার অবসান হলো। সর্বশেষ শুনেছিলাম কায়রো এখন যুদ্ধের শহর। শহরজুড়ে অজস্র, অগুনতি ট্যাংক আর সেনাবহর। উদ্বেলিত এই আন্দোলন ছুঁয়েছে আশপাশের শহরগুলোতেও—সুয়েজ, আলেকজান্দ্রিয়া আমাদের অতি পরিচিত জায়গাগুলোতে। আমার সেলফোন বেজেই চলে। ই-মেইলে জমা হয় অসংখ্য মেইল।
২৯ জানুয়ারি
তাহরির স্কয়ার জোরদার হচ্ছে। শহরের অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। আলেকজান্দ্রা চলে গেল খুব ভোরে। যাওয়ার আগেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মিশন কাটছাঁট করে যে ফ্লাইটই পাই, আমিও চলে যাব। ছোট্ট আয়ুশা আর তার বাবার জন্য অস্থির লাগছে। এদিকে দীআ বলছে, ‘মা, তুমি চলে গেলে আমার তো কারও সঙ্গেই আর যোগাযোগ থাকবে না।’ কত অনিশ্চিত পরিস্থিতি। দীআকে কথা দিই যেভাবেই হোক আমরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ করব। তখনো জানি না সেই ‘যেভাবে’টা কীভাবে।
অফিসে থাকতেই জানলাম, পরদিন ভোরবেলা একটা টিকিট পাওয়া গেছে। মাসকাট থেকে মানামা হয়ে কায়রো। বলা হলো মানামা পর্যন্ত কনফার্ম কিন্তু তারপর মানামা-কায়রো সেক্টরটি অনিশ্চিত। আমি তাতেই রাজি। সন্ধ্যায় আলেকজান্দ্রার ফোন পেলাম। বলল, ‘জানো! মনে হলো যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। সারা রাস্তা ট্যাক্সিতে বসে গা ছমছম করছিল।’
৩০ জানুয়ারি
ভোর চারটায় মাসকাট এয়ারপোর্টে চেক-ইন করি। কায়রো পর্যন্ত বোর্ডিং পাসও পেয়ে যাই। তবুও এয়ারলাইন স্টাফ সতর্ক করে দেন যে মানামা-কায়রো ফ্লাইটটি অনিশ্চিত। লাউঞ্জে বসে আছি। হাতে সেলফোনটা অসম্ভব রকম নিশ্চুপ। কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারছি না।
গত রাতে আমেরিকায় আমার বোন আর কাতারে আমার ভাইকে বলেছি দীআকে নিয়মিত যোগাযোগ করে আমাদের খবরাখবর জানাতে। কী হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না। লাউঞ্জের টেলিভিশনে কায়রো দেখাচ্ছে। জানা গেল, সম্ভবত সেলফোনগুলো চালু করা হয়েছে। শোনামাত্র কায়রো ফোন করার চেষ্টা করলাম। লাইন পাওয়া গেল না।
এর মধ্যে দুজন তরুণ এসে আমার পাশে বসল। কায়রো নিয়ে কথা বলছে। আমার সীমিত আরবি দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলি। ওরা কায়রো যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করি, এমন ‘ক্রিটিক্যাল’ সময়ে ওরা কায়রো কেন যাচ্ছে। দুজনই একসঙ্গে জবাব দেয়, ‘কী বলো! যাব না! আমাদের প্রয়োজন তো এখনই। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তাহরির স্কয়ারে যাব। শুধু আমরা নই, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের বন্ধুরা দেশে যাচ্ছে। যে জোয়ার আজ তাহরিরে এসেছে, তার স্রোতে ভেসে যাক দুঃশাসন।’ আমি অপলক চেয়ে থাকি ওই প্রত্যয়ী মুখগুলোর দিকে। কোথায় সেই বন্ধুসুলভ হাসি! চার বছর ধরে যাদের দেখে এসেছি আরামপ্রিয় হালকা স্বভাব, হাসিখুশি মানুষগুলো সব কোথায় চলে গেল! ঝকঝকে মুখ ধকধকে চোখ, প্রত্যয়ী পদক্ষেপ—এরা কে!
অবশেষে কায়রোর পথে ওড়া। একসময় প্লেনের চাকা স্পর্শ করে কায়রোর মাটি।
এর মাঝে ঘড়ির কাঁটা ‘তিন’ ছুঁয়েছে। শহরজুড়ে শীতের বিকেলে কুয়াশার মতো ঢেকে আছে কারফিউ। আমার হাত থেকে স্যুটকেসটা নিয়ে তাড়া লাগাল ফিরোজ, ‘জলদি চলো। কারফিউ শুরু হয়ে গেছে।’ ট্যাক্সিতে উঠছি। চালক ছাড়াও আরও একজন স্থানীয় লোক সামনে বসে আছে। জানা গেল, নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা। আমরা রওনা হলাম। জায়গায় জায়গায় আর্মি চেকপোস্ট। রাস্তাজুড়ে দুর্বিনীত ট্যাংকবহর। আমরা থামছি। মিসরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া আমাদের কূটনৈতিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে পার হয়ে যাচ্ছি।
৩১ জানুয়ারি
সেই গৃহবন্দী। উত্তপ্ত তাহরির।
আমেরিকা বলছে। ইউরোপ বলছে।
সৌদি আরব বলছে। শুধু যার বলার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে তাহরির স্কয়ার, সে কিছুই বলছে না। ক্যাথরিন ফোন করে জানাল, লুট হয়ে গেছে কারফুর—আমাদের মুদির দোকান। আগুন জ্বলছে সিটি সেন্টারে। এলেক্স আর রায়ানা জানাল, ওদের হাতে টাকা-পয়সা শেষ হয়ে আসছে। এটিএম বুথগুলো টাকাশূন্য। লুট হয়ে গেছে অনেক এটিএম। রুটি পাওয়া যাচ্ছে না। এলেক্স ঘরে বসে রুটি তৈরি করে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে দিচ্ছে কাউকে কাউকে। নির্ঘুম আরও এক রাত।
১ ফেব্রুয়ারি
অফিস থেকে জানানো হলো আমাদের কায়রো থেকে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে। রাত ১২টায় জানা গেল, পরদিন সকাল আটটায় আমাদের যাত্রা। বাড়ি থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে এয়ারপোর্টে কারফিউ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই। এবার প্রস্তুতির পালা। আমি আর ফিরোজ দুজন দুজনের দিকে তাকাই, কী নেব আর কী নেব না। আবার ফিরব কি না, জানি না। ফিরলেও কবে তা-ও জানি না। শুধু আয়ুশার কিছু কাপড়চোপড় আর অত্যাবশ্যকীয় টুকটাক জিনিস প্যাক করে নিলাম। আরও একটা নির্ঘুম রাত।
২ ফেব্রুয়ারি
কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে কারফিউ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরাসহ আমাদের আরও দুই সহকর্মী আর তাদের পরিবার এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম। জাতিসংঘের একটা বিশেষ ফ্লাইটে আমরা যাব। সাইপ্রাস আর দুবাইয়ের মধ্যে আমরা দুবাই বেছে নিলাম। ক্ষীণ আশা, ওখান থেকে বাংলাদেশে যদি যেতে পারি।
মোটামুটি ১০০ জনের একটা দল নিয়ে প্লেনটি আকাশে উড়ল দুবাইয়ের উদ্দেশে। একসময় আমরা দুবাই পৌঁছাই। রাত তখন আটটা। অফিস থেকে জানাল, রাত ১০টায় আমাদের পরবর্তী ফ্লাইট, ঢাকা যাওয়ার। কাতার এয়ারলাইনসে রিপোর্ট করতে হবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তারক্ষীদের আর দুবাই এয়ারপোর্টের কর্মকর্তাদের দক্ষ ব্যবস্থায় আমাদের স্যুটকেস দুটো পাওয়া গেল। এখান থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে আরেকটা টার্মিনালে যেতে হলো। হাতে তখন আর এক ঘণ্টা সময়। যখন চেক-ইন করছি, তখন আর মাত্র আধ ঘণ্টা বাকি। আমরা মাত্র চারজন (আমি, ফিরোজ, আয়ুশা আর ইরানের ডা. মোহিত) টিকিট পেলাম। বাদবাকি সবাই দুবাই থেকে যাচ্ছে এবং যখন টিকিট পাওয়া যাবে, তখন যার যার দেশে ফিরে যাবে।
প্লেনে উঠে সিটে বসতেই গভীর ঘুমে বুজে এল চোখের পাতা।
৩ ফেব্রুয়ারি
প্লেন ঢাকায় ল্যান্ড করছে। ফিরোজ দীআ আমাদের ডেকে দিল। ও রাতের খাবার প্লেনে খেয়েই ঘুম দিয়েছে। প্লেন থেকে নেমে বাসায় এলাম। নিজের ঘরে, নিজের বাড়িতে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। ঘরে ঢুকে আবার টেলিভিশন। কায়রো তখনো টগবগ করে ফুটছে।
৪ ফেব্রুয়ারি
সারা দিন আমরা ঘুমিয়ে কাটালাম। কয়েকবার ফোন বাজল। কায়রো থেকে জানতে চাইছে, আমরা পৌঁছলাম কি না, ঠিকমতো। একটি নিশ্চিন্ত রাত কাটল।
৫ ফেব্রুয়ারি
সকালে উঠে আমি কম্পিউটারের সামনে বসি। অফিস করি অনলাইনে। আয়ুশা স্কুল করছে অনলাইনে। তারপর টেলিভিশনের সামনে বসি আর আমাদের কায়রো দেখি।
রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাই।
৬ ৭ ৮ ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি
মোবারক থাকছে।
তাহরির উত্তপ্ত হচ্ছে।
এক দিকে ৩০ বছরের মোহ, অন্যদিকে এত দিনের জমানো ক্ষোভ আর অস্তিত্বের লড়াই।
১১ ফেব্রুয়ারি
সাবেক এক সহকর্মীর বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াত। উপস্থিত সবাই কায়রোর গল্প শুনতে চায়। গুলশান লেকের প্রায় ওপরেই বাড়িটি। ঝিরঝির বাতাস ঘরময়। ভালোই লাগছে। এর মধ্যেই বিপ বিপ শব্দ। আমার সেলফোনে টেক্সট মেসেজ। তিন শব্দের ছোট্ট একটা টেক্সট কায়রো থেকে, ‘মোবারক স্টেপস ডাউন’। আমি বেশ উত্তেজিত। দৌড়ে ফিরোজকে দেখালাম। ও আমাদের হোস্টকে বলল, ‘আল-জাজিরা’ একটু দেন তো ভাই। সম্ভবত ‘কাজ’ হয়েছে। ব্রেকিং নিউজ স্ক্রল করছে, মোবারক ডিউডেস টু স্টেপ ডাউন’।
পর্দায় উন্মাতাল তাহরির স্কয়ার। আমার ফোন বাজছে। কায়রোর নম্বর। কল রিসিভ করতেই টেলিভিশনের উত্তেজনা সেলফোনে ভেসে এল। আমার মিসরীয় বন্ধু ফোন করেছে তাহরির থেকে। স্থির অবিচল গলায় বলল, ‘উই ডিড ইট।’
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।