আমার জীবন সঙ্গিনী, সুখ-দুঃখের উৎস, প্রিয়তমা নাজিয়া,
এই মুহুর্তে তোমার শেষ চিঠি আমার সম্মুখে রয়েছে। বিশ্বাস কর তোমার চিঠির অভিব্যক্তি আমার হৃদয় আবিষ্ট করে আছে। তোমার মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিনা, কিন্তু সুন্দর আঙ্গুলগুলি চিঠির লাইন ও শব্দের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, রজনীগন্ধার পাপড়ির মত যে সুন্দর আঙ্গুলগুলি কালো চুল নিয়ে খেলা করত। মাঝে মাঝে অন্ধকার তাঁবুর মধ্যে তোমার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি আমার চোখের পর্দায় ভেসে উঠে।
হায়! তুমি লিখেছ আমি তোমাকে ভুলে গেছি এবং তোমার ভালোবাসার মর্যাদা দিচ্ছিনা।
তুমি বলেছ, আমি তোমার ভালোবাসার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছি এবং সুদূর পরিত্যক্ত জায়গায় আগুন এবং রক্ত নিয়ে খেলা করছি। নিজের সম্পর্কে উক্তি করেছ- ‘আমি একজন উদাসী মহিলা যে উদ্বিগ্ন হয়ে রাত্রির তারকারাশিকে গুনে চলেছি।’ আরও বলেছ, আমি ভালোবাসি যুদ্ধ এবং তরবারীকে। তুমি আমাকে ভুল বুঝে অভিযোগ করেছ, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় গভীর আন্তরিকতায় পূর্ণ যে ভালোবাসা আমার প্রতি প্রদর্শন করেছ তা আমার হৃদয়কে সব সময় ক্ষত-বিক্ষত করছে। আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাব তোমার চেয়ে প্রিয়তমা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তোমাকে বোঝাবার ভাষা আজও আমি অর্জন করতে করতে পারিনি। তুমি আমার স্নেহ প্রীতি ভালোবাসার সর্বোচ্চ সীমায় রয়েছ। তোমার পুর্বে কাউকে আমি ভালোবাসিনি এবং একমাত্র তুমিই আমার হৃদয় চুরি করেছ। তাহলে কি জিনিস তোমাকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে? ও আমার হৃদয়ের আনন্দ শোন-
আমি তোমার থেকে দূরে নেই, কারণ জাগতিক লাভ ও সম্পদের প্রত্যাশী আমি নই কিংবা আমার শত্রুরা যে রকম শতমুখে প্রচার করে বেড়ায় - আমি রাজা হতে চাই, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চাই, এ রকম কোন অভিলাষ আমার নেই। তোমার থেকে দূরে থাকার একমাত্র কারণ আল্লাহর বাধ্যতামূলক আদেশ আমাকে এ যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে এনেছে। আল্লাহর দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ ফরজ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। একথা আল্লাহরই নির্দেশ। তাঁর এ নির্দেশ পালন করার অভিলাষই মানুষকে জান্নাতুল ফিরদৌসের অধিকারী করে।
আলহামদুলিল্লাহ! আমি আবেগময়ভাবে এ নির্দেশ পালন করছিনা। গভীর আন্তরিকতায় সক্রিয়ভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে সে নির্দেশ পুর্ণভাবে পালন করায় রত আছি। তোমার অনুপস্থিতি তীরের মত প্রতি মুহুর্তে আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে। এসব সত্ত্বেও আমি এই বিচ্ছিন্নতায় খুশি, তোমার এই নিঃসঙ্গ প্রকৃত ভালোবাসা আল্লাহর পথে আমার কাছে সবচে’ বড় পরীক্ষা এবং চ্যালেঞ্জ।
আল্লাহর দরবারে হাজার শুকরিয়া, আমি ব্যক্তিগত কামনা বাসনা ভালোবাসা আনন্দকে উপেক্ষা করে সার্থকভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ও নির্দেশ কে রক্ষা করতে চেষ্টা করছি। প্রিয়তমা! তুমিও নিশ্চয় আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাবে আল্লাহতাআলার প্রতি প্রেমের জন্য তোমার প্রেমকে ত্যাগ করতে পেরেছি বলে।
যদিও তোমার পক্ষে তরবারি হাতে যুদ্ধ করা ফরজ নয়, তবু তুমি এথেকে দূরে থাকতে পার না। তোমার জিহাদ হল আল্লাহর পথে তোমার সমস্ত ভালবাসা উৎসর্গ করে দেওয়া। তোমার ব্যক্তিগত কামনা বাসনা আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর ভালবাসা লাভের জন্য তাঁর সন্তষ্টির পথে চলা, তাহলেই স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনকে দৃঢ় করতে পারবে এবং আত্নশক্তিতে বলীয়ান হবে। কখনও প্রার্থনা করোনা, আমি নিজেকে বাঁচিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে তোমার ভালোবাসার দুই বাহুর মধ্যে ফিরে আসি। … বরং প্রার্থনা করো - আল্লাহ আমাকে সাফল্যের সাথে ফিরিয়ে আনুন, অথবা আমার ওষ্ঠাধর যেন শাহাদাতের পেয়ালা পান করে। প্রিয়তমা তুমি ভালো করে যান, এই ওষ্ঠাধর কোন দিন নোংরা সুরা স্পর্শ করেনি এবং কোরআন পাঠ আর পরম করুনাময় আল্লাহর প্রসংসায় ব্যস্ত ছিল।
প্রিয়তমা নাজিয়া। সেই মুহুর্তে তুমি কত সৌভাগ্যশালী হবে যে দিন আমি আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে যাব। ভালোবাসায় বিগলিত হয়ে যে শরীরকে সুন্দর বলতে সেই শরীর মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সে দিন তোমার দৃষ্টিতে আমার এই শরীর কেবল একজন সৈনিকের শরীর হিসেবে প্রতিভাত হবে না। এই শরীর তোমার প্রেমিকের সুন্দর শরীর। আমার ইচ্ছা আমি শহীদ হয়ে যাব, কিয়ামতের দিন খালিদ বিন ওয়ালিদের (রা) সাথে মিলিত হব। এ জগত ক্ষণস্থায়ী অবশ্যই মৃত্যু আসবে। মৃত্যুকে কে ভয় করে? মৃত্যু যদি সত্য হয় তবে কেন মানুষ অলসভাবে বিছানায় শুয়ে মৃত্যুবরণ করবে? আল্লাহর পথে মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয়, প্রকৃতপক্ষে চিরন্তন জীবন। নাজিয়া, আমার ইচ্ছা শোন। যদি আমি শহীদ হয়ে যাই, আমার ভাই নূরী পাশার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো। তোমার পরেই আমার কাছে প্রিয়তম ব্যক্তি হল নূরী। আমার মৃত্যুর পর নূরী তোমাকে আমৃত্য বিশ্বস্ততার সাথে তত্তাবধানে রাখুক। আমার পরবর্তী ইচ্ছা তোমার যে সন্তান হবে তাদের তুমি পালন করবে এবং আমার জীবনের কথা বলবে এবং ইসলামের জন্য, আমাদের দেশের জন্য যুদ্ধে পাঠাবে। যদি তুমি আমার ইচ্ছা স্মরণে না রাখ, তবে আমি জান্নাতে গিয়েও তোমার উপর রাগান্বিত থাকব।
বিদায়! আমার কল্যাণীয়া প্রিয়তমা! আমি জানিনা কেন, আমার অনুভূতি বলছে এই চিঠি লিখার পর তোমাকে আর কোন চিঠি লিখতে সমর্থ হবনা। এটা বিস্ময়কর নয় যে আগামীকালই শহীদ হয়ে যেতে পারি।* দেখ, আমার মৃত্যুতে ধৈর্য ধরো। সুখী থেক। বিলাপ করোনা। আল্লাহর পথে আমার এই মৃত্যু তোমার পক্ষেও সম্মানজনক।
নাজিয়া! আমি এখন ইচ্ছা করছি তোমাকে ও জাগতিক চিন্তাভাবনা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে। মনে মনে আমি তোমায় ভালবাসাপূর্ণ আলিঙ্গন করছি। ইনশাআল্লাহ আমরা জান্নাতে মিলিত হব এবং তারপর আমাদের আর কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারবেনা।
- তোমার আনোয়ার
[গাজী আনোয়ার পাশা (১৮৮২-১৯২২) তুরষ্কের একজন বিখ্যাত মুজাহিদ। সারাজীবন তিনি ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। রাশিয়ান বলশেভিকদের হাতে তিনি শহীদ হয়ে যান। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে তিনি তাঁর স্ত্রী নাজিয়া সুলতানাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এই চিঠিটা লেখেন। চিঠিটি তুরষ্কের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয় ২২শে এপ্রিল, ১৯২৩]
বিষয় সমুহ...
বিভাগীও শহর তথ্য কনিকা
আরো কিছু গুরুত্তপূর্ণ বিষয়...
একটি ঐতিহাসিক চিঠিঃ প্রিয়তমাকে লেখা গাজী আনোয়ার পাশার শেষ চিঠি
মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০১১অন্তরভুক্ত বিষয় ছুটির দিনে
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।