গাদ্দাফির বাসভবন চত্বরে হামলা

বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১১

লিবিয়ায় হামলার জন্য জাতিসংঘের সম্মতি পেতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা বলেছিল, তাদের হামলার লক্ষ্য গাদ্দাফি নন। তারা লিবিয়ার সাধারণ নাগরিকদের গাদ্দাফি বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। কিন্তু গত রোববার রাতে পশ্চিমা বাহিনী ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির বাসভবন চত্বরেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে গুঁড়িয়ে গেছে একটি ভবন। তবে কেউ হতাহত হয়নি। তবে গাদ্দাফি কোথায় আছেন, তা জানা যাচ্ছে না। আরব লীগ ও রাশিয়া পশ্চিমা বাহিনীর এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এদিকে বিদ্রোহী-অধিকৃত মিসরাতা শহরে গতকাল সোমবার গাদ্দাফি বাহিনীর হামলায় ৪০ জন নিহত হয়েছে।
ত্রিপোলি থেকে বিবিসির এক সাংবাদিক জানান, রোববার রাতে ত্রিপোলিতে অনেকগুলো হামলা হয়। একপর্যায়ে শহরের দক্ষিণাংশে অবস্থিত বাব আল-আজিজিয়া চত্বরের মধ্য থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে দেখা যায়।

লিবিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের পাশে গাদ্দাফি অনুগত সেনারা
লিবিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের পাশে গাদ্দাফি অনুগত সেনারা

বাব আল-আজিজিয়া ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির প্রধান সামরিক ঘাঁটি। প্রায় ছয় বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে অবস্থিত এই ঘাঁটির মধ্যে রয়েছে গাদ্দাফির বাসভবনসহ বেশ কয়েকটি ভবন। যে ভবনটি হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে, সেখান থেকে তিনি সামরিক নির্দেশনা দিতেন। তবে রোববার রাতে হামলার সময় তিনি সেখানে ছিলেন কি না জানা যায়নি। ১৯৮৬ সালে এই চত্বরে হামলা চালিয়েছিল মার্কিন বিমান।
গতকাল সোমবার সকালে পশ্চিমা সাংবাদিকদের ওই চত্বরে নিয়ে যান লিবিয়ার কর্মকর্তারা। সাংবাদিকেরা দেখতে পান, চারতলা একটি ভবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে, তবে হামলায় কেউ হতাহত হয়নি।
লিবিয়া সরকারের মুখপাত্র মুসা ইব্রাহিম সেখানে সাংবাদিকদের জানান, গত রাতে যে হামলা চালানো হয়েছে, তা বর্বরোচিত। এতে অনেক মানুষ মারা যেতে পারত। কেননা, হামলায় যে ভবনটি ধ্বংস হয়েছে, তার থেকে মাত্র ৪০০ মিটার দূরে গাদ্দাফির বাসভবনের সামনে ওই সময় জড়ো হয়েছিল শত শত মানুষ।
পশ্চিমাদের বক্তব্য: ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, তাদের রাজকীয় বিমানবাহিনীর টর্নেডো জঙ্গি বিমান থেকে বাব আল-আজিজিয়ায় হামলা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জোট বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ওই হামলায় গাদ্দাফির সামরিক কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে গেছে। যেসব স্থাপনা লিবিয়ার মানুষের জন্য হুমকি, জোট বাহিনী সেখানে হামলা অব্যাহত রাখবে।
তবে গাদ্দাফিকে হত্যার জন্য ওই হামলা চালানো হয়নি বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস বলেন, ‘এমনটা ধরে নেওয়া অনুচিত হবে। আমার মনে হয়, এটা মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা জাতিসংঘ প্রস্তাবের অধীনেই এই অভিযান চালাচ্ছি।’
গাদ্দাফির অবস্থান জানা গেলে সেখানে হামলা চালানো হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লরেন তিয়েসিরে বলেন, ‘না’।
তবে গাদ্দাফির ওপর হামলার সম্ভাবনা নাকচ করে দেননি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ। তিনি বলেন, ‘এটা নির্ভর করবে সময় ও পরিস্থিতির ওপর।’
পেন্টাগনে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে মার্কিন নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল উইলিয়াম গরটনে জানান, ত্রিপোলি থেকে পূর্বে বেনগাজি পর্যন্ত আকাশ জোট বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এর ফলে নো ফ্লাই জোন পুরোপুরি কার্যকর হয়েছে।
আরব লীগের নিন্দা: লিবিয়ার বেসামরিক লোকজনকে রক্ষার স্বার্থে নো ফ্লাই জোন আরোপে সমর্থন ছিল আরব দেশগুলোর সংস্থা আরব লীগের। তবে গত দুই দিনের নির্বিচার বিমান হামলায় ক্ষুব্ধ হয়েছে আরব লীগ।
গতকাল কায়রোতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আরব লীগের মহাসচিব আমর মুসা বলেন, ‘লিবিয়ায় যা ঘটছে, তার সঙ্গে নো ফ্লাই জোন আরোপের লক্ষ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমরা বেসামরিক লোকজনকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, তাদের ওপর আরও বোমা ফেলতে চাইনি।’
তবে আমর মুসা জানান, এর পরও আরব লীগ জাতিসংঘ প্রস্তাবের সঙ্গে আছে এবং একসঙ্গে কাজ করে যাবে।
রাশিয়ার প্রতিবাদ: লিবিয়ার ওপর হামলার বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে সমর্থন করেনি চীন ও রাশিয়া। তবে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এই দুই দেশ ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো দেয়নি। লিবিয়ায় গত দুই দিনের হামলার পর রাশিয়া বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে।
জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবকে ‘মধ্যযুগীয় ধর্মযুদ্ধের আহ্বান’ অভিহিত করে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল বলেন, ‘বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার কথা বলে লিবিয়ায় বেপরোয়া হামলা চালানো হচ্ছে। এর পেছনে কোনো যৌক্তিকতা নেই, নেই কোনো নৈতিকতা।’
বিদ্রোহীরা যা চাইছে: গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর ওপর জোট বাহিনীর হামলাকে স্বাগত জানিয়েছে লিবিয়ার বিদ্রোহীরা। তবে তারা বলেছে, আকাশ থেকে হামলা চালানো হোক, কিন্তু কোনো বিদেশি সেনা যেন তাদের স্থলভাগে অভিযান না চালায়।
গতকাল বেনগাজিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্রোহীদের মুখপাত্র আহমেদ আল-হাসি জানান, তাঁদের লক্ষ্য এখন ত্রিপোলি দখল। তাঁরা নিজেরাই সেটা করতে চান, কোনো বিদেশি স্থলবাহিনীর সহায়তায় নয়। তিনি জানান, বিদ্রোহী নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই বিমান হামলা চালাচ্ছে পশ্চিমা বাহিনী।
বেনগাজিসহ বিভিন্ন শহরের অবস্থা: বিদ্রোহীদের প্রধান ঘাঁটি পূর্বাঞ্চলের শহর বেনগাজি। সেখানকার এক বাসিন্দা রয়টার্সকে জানান, রোববার রাতে শহরে ভারী বন্দুকযুদ্ধ ও বড় বড় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
পশ্চিমা বাহিনীর বিমান হামলার পর গাদ্দাফি বাহিনী বেনগাজি শহর থেকে আরও প্রায় ১০০ কিলোমিটার পিছু হটেছে। আশ্রয় নিয়েছে বেনগাজির দক্ষিণের শহর আজদাবিয়াহতে।
বেনগাজির পূর্বের শহর মিসরাতাও গাদ্দাফি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। সেখানকার বাসিন্দারা জানান, গাদ্দাফি বাহিনী বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে। গতকাল হামলায় সেখানে ৪০ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। গাদ্দাফি বাহিনী ট্যাংকের গোলায় শহরটি ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে।
বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত তোবরুক শহর থেকে বিবিসির সাংবাদিক কেভিন কনোলি জানান, বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে জোট বাহিনী মিসরাতা শহরে গাদ্দাফি বাহিনীর ওপর হামলা করতে পারবে কি না বলা যাচ্ছে না।
মিসরাতার এক বিদ্রোহী নেতা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, জোট বাহিনীর হামলা ঠেকাতে গাদ্দাফি বাহিনী বেসামরিক লোকজনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
ব্রিটেন গতকাল জানায়, রাতে বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা, জোট বাহিনী যেসব লক্ষ্যে হামলা চালাতে চায়, সেখানে বেসামরিক লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। তবে কোন লক্ষ্যে তারা হামলা চালাতে চায়, সে সম্পর্কে কিছু বলেনি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
আবার যুদ্ধবিরতির ঘোষণা: জোট বাহিনীর হামলার দুই দিন না যেতেই গত রোববার রাতে আবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে লিবিয়া কর্তৃপক্ষ। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, লিবিয়া ইতিমধ্যে নো ফ্লাই জোন লঙ্ঘন করেছে, কাজেই হামলা অব্যাহত থাকবে। এর আগে গত শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নো ফ্লাই জোন এবং প্রয়োজনে সীমিত হামলার প্রস্তাব পাস হওয়ার পরপরই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় গাদ্দাফি সরকার।
মারা গেছেন গাদ্দাফির ছেলে: গাদ্দাফির ছেলে খামিশ গতকাল ত্রিপোলির একটি হাসপাতালে মারা গেছেন বলে আরবের বিভিন্ন গণমাধ্যম জানায়। গত শনিবার লিবিয়ার বিমানবাহিনীর এক পাইলট তাঁর বিমান নিয়ে বাব আল-আজিজিয়া কম্পাউন্ডে হামলা চালান। এতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। খামিশ ওই হামলায় গুরুতর আহত হন। পরে মারা যান।
যুদ্ধের আরও আয়োজন: ফ্রান্সের বিমানবাহী রণতরী শার্ল দ্য গল লিবিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছে। ডেনমার্ক ও নরওয়ে পাঠাচ্ছে ছয়টি করে জঙ্গি বিমান। স্পেন ইতিমধ্যে তিনটি বিমান পাঠিয়েছে। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য জঙ্গি বিমান প্রস্তুত রেখেছে ইতালি। কানাডা ইতিমধ্যে ছয়টি বিমান পাঠিয়েছে ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ সিসিলিতে এবং সেগুলো হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে অভিযানে অংশ নিতে যাচ্ছে কাতার। তারা চারটি বিমান পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া আরও অনেক দেশ অভিযানে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দাবি করেছেন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা।
ইরাক গতকাল জানিয়েছে, তারা লিবিয়ায় পশ্চিমা বাহিনীর হামলাকে সমর্থন করে। তবে দেশটির শিয়া ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল-সদর লিবিয়ায় হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।
লিবিয়াকে নো ফ্লাই জোন ঘোষণা-সংবলিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৭৩ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয় গত বৃহস্পতিবার। এতে শুধু গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর হাত থেকে লিবিয়ার বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার জন্য লিবিয়ার বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু গাদ্দাফি বাহিনী নো ফ্লাই জোন লঙ্ঘন করেছে জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে পশ্চিমা বাহিনী গত শনিবার রাতে লিবিয়ার বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। রোববার রাতেও হামলা চালানো হয় বিভিন্ন শহরে।
পশ্চিমা বিমান হামলায় শনিবারই ৬৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় বলে দাবি করে লিবিয়া কর্তৃপক্ষ। তবে জোট বাহিনী জানায়, তাদের হামলায় কোনো বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়নি। রোববার রাতের হামলায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসেন কর্নেল গাদ্দাফি। এর পর থেকে প্রায় ৪২ বছর ধরে তিনি দেশ শাসন করছেন। তাঁর শাসনের অবসানের দাবিতে গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে লিবিয়ায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা বেনগাজি ও ত্রিপোলির পশ্চিমের শহর জাবিয়াহসহ বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয়। গাদ্দাফির অনুগত সেনাদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। সূত্র: এএফপি, বিবিসি, আল-জাজিরা ও রয়টার্স।

0 আপনার মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।

Avro Keyboard - Unicode Compliant FREE Bangla Typing Softwareবাংলা লিখার সপ্টওয়্যার আভ্র ডাউনলোড করতে খানে ক্লিক করুন
 
 
 

বিশাল বাংলা

কম্পিউটার প্রতিদিন

রাজনীতি...

বিনোদন

খেলার খবর

অর্থ ও বাণিজ্য