দেশের বর্তমান হালহকিকত দেখে আর গণমাধ্যমগুলোর খবর জেনে একটা অজানা ভয় সারাক্ষণ মনে উঁকি মারছে। মনে হয় কিছু একটা ঘটবে। দ্রব্যমূল্যের বাধাহীন ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, শাসক দলের পেটোয়া বাহিনীর বেপরোয়া সন্ত্রাস, বিদ্যুত্-গ্যাসের হাহাকার, নারী উত্ত্যক্তকারী অতি নিকৃষ্ট ছ্যাঁচদের অসভ্য সন্ত্রাস-হত্যা, ছিনতাইকারীদের কবলে সাধারণ মানুষের জান-মাল, ছিনতাই, এমনকি পুলিশ প্রহার সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা। বিরোধী দলগুলোর প্রত্যাশিত প্রতিবাদী ভূমিকাও যেন ভোঁতা অস্ত্রের মতো অকার্যকর। তাই বলে প্রতিবাদ থেমে নেই। যখন যে জনগোষ্ঠী আহত, নির্যাতিত এবং স্বজনহারা হচ্ছে দল-ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে নিজেদের রক্ষা করতে, বিচার পেতে নিজেরাই সংগঠিত হচ্ছে, রাস্তায় ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে নেমে পড়ছে। কাউকে ডাকতে হচ্ছে না। প্রতি-ইস্যুও সৃষ্টি হচ্ছে প্রচণ্ডবেগে। কিন্তু সবই খণ্ড, খণ্ড, এলোমেলো প্রতিবাদ। এসব ঐক্যবদ্ধ করার মতো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেউ এগিয়ে এসে বলে না, ‘আমি বা আমরা আছি, ভয় নাই, আগে বাড়ো।’
সরকারি দল স্বভাবগুণে যথারীতি বলে, ‘সবই তো ঠিকমতো চলছে, দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া, আর এসবের উস্কানিদাতা ওই বিরোধী দল।’ আসলে প্রশ্ন হচ্ছে বিচ্ছিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা আইনের কিতাবে আছে কি? ঘটনাগুলো কি দেশ-সমাজ-ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন অন্য কোনো গ্রহের ঘটনা? নাকি এসব অপকাণ্ডে তাদের দলীয় নেতাকর্মীরা সম্পৃক্ত? আমরা চাই যথাযথ বিচার এবং সমাধান। কে জড়িত বিষয়টা নিরপেক্ষতা পাক এটাই দাবি। সরকারি দলের বক্তব্য এমন যদি আকাশ থেকে উল্কাপাতে ২/১ জন মারা যায়, তবে বিরোধীদের দায়ী করবে, ‘এটা ওদের ষড়যন্ত্র’ বলে। অবিশ্বাস করার কারণ নেই, যারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায়, তাদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা আড়াল করে তাদের জন্য করুণাই হয়। যারা নিজেদের কৃতকর্মের অসারতা বুঝতে অক্ষম, ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ, তারা হয় ইতিহাস জানে বা বিশ্বাস করে না, নিজেদের ইতিহাসই এর মধ্যে ভুলে বসে আছে। অতএব তাদের পতন এখন সময়ের ব্যাপার। প্রয়োজন এখন এমন একজন নেতার যিনি সঠিকভাবে এই বিশৃঙ্খল জনপদকে ঢেলে সাজিয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে জাতিকে সাহায্য করবেন। যে দলটি নিজেদের কর্মী নিয়ন্ত্রণে রাখতে অক্ষম, তারা ১৭ কোটি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে? হয়তো এমনও হতে পারে বর্তমান দলগুলোর মধ্য থেকেই কোনো বিবেকবান নেতা বেরিয়ে আসতে পারে। অতএব ধরা যায় প্রচণ্ড গণআন্দোলন শিগগিরই আমাদের আন্দোলিত করবে এবং আল্লাহ্ চাহে তো আমরা আবার রাহুমুক্ত হবো। যদি তা না হয় তবে বুঝতে হবে সব শ্রেণীর নারী-পুরুষের বর্তমান যে আত্মত্যাগ আর প্রতিদিনের আহাজারি এর অবসান হতে আরও কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে কে জানে?
সরকারি দল অপকর্মগুলো করেও যদি কথামালার কৃচ্ছ্রসাধন করতো তবু দেশের রাজনীতিতে এত উত্তাপ সৃষ্টি হতো না। এইতো ক’দিন আগে মাননীয় আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বললেন, বিএনপি একটা ককটেল পার্টি, এতে অমুক অমুক দলের লোকজন আছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে প্রশ্ন করতে চাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কি আগে কোনো দল করতেন না? বর্তমান আওয়ামী লীগে কি কোনো বিচ্ছিন্ন জগতের আনকোরা লোকই আছে? আপনি খোঁজ নিন, দেখবেন মুসলিম লীগার, কমিউনিস্ট, জাতীয় পার্টির সদস্য এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন প্রশিক্ষিত রাজাকার কমান্ডার প্রশিক্ষিত আলবদরও আছে। শ্রীযুক্ত বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী আগে কোন দলের নেতা ছিলেন? তাহলে কি আওয়ামী লীগকে ‘খিচুড়ি পার্টি’ বলা সঙ্গত? না, মোটেও নয়। কারণ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটা একটা চলমান ব্যবস্থা। সব দলেরই বিশেষত বড় দলগুলোর রাজনৈতিক মুখপাত্র থাকা উচিত যাঁরা হবেন বিজ্ঞ এবং সংযমী। যাইবা হোক সব দলের প্রতি বিনয়ের সঙ্গে কিছু পরামর্শ থাকবে। তারা তা নিক বা না নিক তাদের বিষয়। আন্দোলন আসছে, আঁধারে শক্তি থেকে সাবধান থাকতে হবে। আঁধারে বলছি এ কারণে যে, তারা ‘জেনেভা কনভেশন’ ভঙ্গ করে আপনাদের ওপর নাজিল হতে পারে এবং আপনাদের বিভ্রান্ত করতে পারে। ক্ষেত্র, ক্ষমতাসীন হোক অথবা বিরোধীপক্ষ। কোনো এক সময়, সুযোগ মতো আপনাদের নির্বোধও বলতে পারে। কারণ তারা ক্ষমতাধর। জার্মানির মি. স্টেফান ফ্রোয়েন ২৮/১০-এ একথা বললেন, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে। উনি ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূত। বিদায়ী এ দূত উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেন আমাদের সৃষ্টি বলে যারা প্রচার চালায় তারা নির্বোধ। জরুরি অবস্থা জারির পেছনে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের ভূমিকা ছিল না।’ কিন্তু আমরা জানি ভদ্রলোক আমাদের নির্বোধ বলে গালি দিলেন এবং মিথ্যা কথাই বললেন। যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা স্বীকার করেছিল এবং এসব দূতের সেসব দিনের তত্পরতা আর বাতচিত্ সেদিন গোপন ছিল না। আসলেই আমরা বোধহয় নির্বোধ। তাই বলি, আপনারা ক্ষমতা লাভের মোহে ওদের কাছে ক্ষমতা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাবেন না। নিশ্চিত জেনে রাখুন, ক্ষমতায় আপনাকে বসাতে চেষ্টা হয়তো করবে, তবে তাদের স্বার্থে আমাদের দেশের স্বার্থে নয়। অতএব নিজেকে এবং জাতিকে আর ছোট করবেন না দয়া করে। সে রকম আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে ওইসব আঁধারে জীবরা সক্রিয় হয়ে ওঠে সরকারি এবং বিরোধী মহলে। গণমাধ্যমগুলোও যেন পারতপক্ষে তাদের ছায়া না মাড়ায়। বিশ্বের কোনো দেশে এই রেওয়াজ নেই। এ জন্য দ্বিধাহীনভাবে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়ী করব। সব সময় আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, ওরা নিজ দেশের স্বার্থে এ দেশে প্রতিনিধিত্ব করছে। আমাদের জন্য নয়।
দেশটা আমাদের ছোট কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা অনেক বড়। আমাদের অতীত ইতিহাস-সংস্কৃতি-সভ্যতা খুব সমৃদ্ধিশালী। আবার পরাশক্তিশালী ২/৪টা দেশ পাবেন যাদের সে রকম কোনো ইতিহাস নেই। এদের মধ্যে কোনোটা দখলদারিত্ব, হত্যা-লুণ্ঠন করেই শক্তিশালী হয়েছে। তাই এদের পক্ষে ইরাকি (আশিরীয়) সভ্যতার হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী জাদুঘর ধ্বংস করতে তাদের তথাকথিত সভ্যতার চেতনা বাধা দেয়নি অথবা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি, যেমনটি করেছিল প্রায় হাজার বছর আগে হালাকু খান। অর্থাত্ সভ্যতার মেয়াদ বিচার করলে এরা আজও হাজার বছর পিছিয়ে আছে। এরাই তাদের কুকুরের খাদ্যাভাব দেখা দিলে প্রথমদিকে রেড ইন্ডিয়ানদের শিশুগুলো জবাই করে খাইয়ে কুকুরের জীবন বাঁচিয়ে ছিল। এই ময়ূরপুচ্ছ ধারণকারী সভ্যদের থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকতে হবে। এদের কারও ইতিহাস হাজার হাজার বছর অন্যের দখলদারিত্ব মেনে নিয়ে আজ স্বাধীন। এই নব্যসাম্রাজ্যবাদের তকমাধারী চরম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তারের মহড়া দিচ্ছে, নিজের ভূখণ্ডের নামে অখণ্ডতা নিশ্চিত না করেই অগণতান্ত্রিকভাবে অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর ওপর অমানবিক নিষ্ঠুরতা চালাচ্ছে আর বৃহত্ গণতান্ত্রিক দেশ বলে নিজেকে জাহির করছে।
আমাদের এরা কতটুকু প্রভাব বলয়ে রাখতে পারবে এটা নির্ভর করছে একান্তই জনগণের সচেতন ইচ্ছার ওপর। কিউবা এর বড় নজির। অতএব জনগণকে প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর। আর সেখান থেকেই হবে আমাদের উত্তরণ। তাই সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের আন্দোলনে যেতে হবে। কেবল স্থুল চিন্তা মাথায় নিয়ে ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং জয় দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
বিষয় সমুহ...
বিভাগীও শহর তথ্য কনিকা
আরো কিছু গুরুত্তপূর্ণ বিষয়...
আন্দোলন ও ক্ষমতা : দেশপ্রেমই ভিত্তি
মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০১১অন্তরভুক্ত বিষয় লেখকের কলাম
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।