‘এই যে ভাই, ফার্মগেটটা যেন কোন দিকে?’ মহাখালী বাস টার্মিনালে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যকে জিজ্ঞেস করছিলেন একজন। প্রশ্নকারীর চেহারার ধরন আর পোশাকের গড়ন দেখে বোঝা যাচ্ছে, শহরে নতুন পা দিয়েছেন। বেশ কিছু সময় পর ট্রাফিক পুলিশের ওই সদস্য মুখ খুললেন, ‘একটু সামনে গেলেই দেখবেন বাস আসে। আর হেলপাররা ‘ফার্মগেট, ফার্মগেট’ বলে ডাকে। তার একটাতে উঠে পড়বেন।’
গ্যালারিতে নির্ভার, কিন্তু পথনির্দেশকের অভাবে ঢাকার পথে বিপাকে পড়েন ক্রিকেট-পর্যটকেরা।
ঢাকার আগন্তুকেরা পথঘাট চেনেন না। নগরের সড়কের ধারে বা মোড়ে পথনির্দেশক না থাকায় পথ চিনে নিতে তাঁদের বিপাকে পড়তে হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ সদস্য, পথচারী ও দোকানিদের কাছ থেকে তাঁরা পথের দিশা খোঁজার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে লোকমুখে শোনা নির্দেশনায় প্রায়ই ভুল ঠিকানায় চলে যান তাঁরা। অথচ নগরে পর্যাপ্ত পথনির্দেশক থাকলে সহজে পথ চেনা যেত বলে মনে করেন নগরের একাধিক আগন্তুক। এগুলোয় বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হলে পর্যটকদের পথ চলতে সমস্যায় পড়তে হতো না। অন্যদিকে মানুষকে পথ চেনানোর কাজে নগরের ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই বলে অভিযোগ করেন অনেক পর্যটক।
কানাডার কালট্রন ও নাওলি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলা দেখতে ঢাকায় এসে পথে কোনো নির্দেশনা নেই দেখে বেশ বিপদেই পড়েছিলেন। তাঁরা দুজনই বাইসাইকেল নিয়ে এসেছেন। ঢাকার পথে ইংরেজি ভাষার পথনির্দেশক না পেয়ে বিপদে পড়েন তাঁরা। ফলে সাইকেল থাকলেও তাঁরা ইচ্ছামতো শহরটাকে ঘুরে দেখতে পারেননি। এ তো গেল দুই কানাডিয়ানের কথা। বাংলাদেশের অন্য জেলা থেকে আসা অনেক মানুষও ঢাকার পথ খুঁজতে ভোগান্তির মধ্যে পড়েন। বরিশালের ছেলে জনি খান ঢাকায় এসেছেন নতুন। সদরঘাট থেকে যাবেন মতিঝিলে। সঙ্গে রয়েছে মোটরসাইকেল। কিন্তু কোথাও কোনো পথনির্দেশক না থাকায় মানুষকে জিজ্ঞেস করতে করতে এগোতে থাকেন তিনি।
হাতেগোনা কয়েকটি ফুটওভারব্রিজের রেলিংয়ে মলিন কিছু পথনির্দেশক চোখে পড়ত। এখন বিশ্বকাপের সাজসজ্জায় সেগুলো ঢাকা পড়ে গেছে। অথচ বিশ্বকাপের এই শহরে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল পথনির্দেশক, এমনটা জানালেন অনেকেই।
বাংলামোটর মোড়ের ফুটওভারব্রিজের গায়ে বিজ্ঞাপনের ব্যানারের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট পথনির্দেশক চোখে পড়ে। কিন্তু অযত্ন আর অবহেলায় ইংরেজিতে লেখা শাহবাগ আর ফার্মগেটের কয়েকটি বর্ণ হারিয়ে গেছে। ফলে এই দুটি এলাকার নাম উদ্ধার করা আগন্তুকের পক্ষে সম্ভব নয়। একই বোর্ডে থাকা মগবাজার ও হাতিরপুল শব্দ দুটি ঢাকা পড়েছে তারের জঞ্জালে।
নগরের বেশ কিছু স্থানে আবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বসানো ঐতিহাসিক নিদর্শনের সাইনবোর্ড রয়েছে। এর অনেকগুলো মরিচা পড়ে কিংবা পোস্টারে ঢাকা পড়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট নিদর্শনের নাম-ঠিকানা ঝোঝা যাচ্ছে না সেসব সাইনবোর্ড দেখে।
এদিকে ২০০৭ সাল থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিকসহ দেশের বিভিন্ন মনীষীর নামে নগরের বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করছে। সড়কগুলোর নতুন নাম জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নামকরণের একটি ভিত্তিফলক স্থাপন করেই দায়িত্ব সেরেছে ডিসিসি। নতুন নাম জনপ্রিয় করার জন্য তারা হাতে নেয়নি কোনো কর্মসূচি। এখনো অনেক সড়কে একই সঙ্গে নতুন ও পুরোনো দুই নামের দেখাই মেলে। এর মধ্যে আছে নাটক সরণি (সাবেক বেইলি রোড), শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কের (সাবেক নিউ সার্কুলার রোড) মতো অনেক সড়ক।
বাংলাদেশ সড়ক ও পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তারা নগরের যান্ত্রিক যানবাহনের নিবন্ধন এবং চালকদের লাইসেন্স দিয়ে থাকে। নগরের সড়ক ও এর মোড়ে পথনির্দেশনা দেওয়ার দাবি করে বিআরটিএর অ্যানফোর্সমেন্ট বিভাগের পরিচালক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘একজন নতুন চালক ঢাকায় রাস্তা চিনতে পারেন না। যানবাহন চালাতে গিয়ে তিনি বিপদে পড়েন। যদি শহরের মোড়ে মোড়ে পথনির্দেশনা থাকত, তাহলে এমনটা হতো না।’
নগরের সড়কে পথনির্দেশনা বসানোর দায়িত্ব কার? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি আঙুল দেখায় ডিসিসির দিকে। আবার ডিসিসির কোনো কোনো কর্মকর্তা ডিএমপির ওপর দায় চাপান। তবে ডিসিসির মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এত দিন ভাবিনি। আমরা পথনির্দেশক বসানোর পরিকল্পনা করব।’ এদিকে নগরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার জন্য নতুন করে পথনির্দেশক বসানো হবে কি না, জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক (ঢাকা অঞ্চল) আবদুল খালেক বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে তাঁরা চিন্তাভাবনা করবেন।
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।