গোলাম আরিফ টিপু। ৫০-এর দশকে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। জেল খাটেন। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার উদ্যোগে দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় রাজশাহীতে। এ দেশের সব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে কাজ করেছেন। দেশ সেরা ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ পেশাগত জীবনে সাফল্যের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। এই প্রখ্যাত আইনজীবী এখন যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে গত ১ এপ্রিল কথা হয় 'বাংলাদেশ প্রতিদিন'-এর সঙ্গে।
চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু
বাংলাদেশ প্রতিদিন : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার বর্তমান অবস্থা কি, কোন প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছেন?
গোলাম আরিফ টিপু : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি জাতীয় কর্মসূচি। সারাদেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই বিচার চায়। এক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থ পরিষ্কার। জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন। আমরা যারা প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ করছি বা জড়িত তারা আন্তরিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। ট্রাইব্যুনাল যথাযথ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বাস করি এবং মনে প্রাণে ধারণ করি বিচার আমরা সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : যে ভাবে বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তাতে আরও গতি আনা সম্ভব কি?
গোলাম আরিফ টিপু : দ্রুত এগোবার কিছু নেই। ৪০ বছর আগের ঘটনা। প্রতিটি মামলাই দূর-দূরান্তে ঘটনার স্থান। সেখানকার মানুষজনই সাক্ষী। সেই সময়ের অনেক মানুষ এখন জীবত নেই। অনেকে বৃদ্ধ। এই অবস্থায় বাস্তব ভিত্তি নির্ভর করে তদন্ত কাজ এগোচ্ছে। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত এবং পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া প্রমাণ্য দলিলপত্রের ভিত্তিতেই বিচার প্রক্রিয়া এগোচ্চে। পাশাপাশি অনেকের কাছে স্থিরচিত্র, ভিডিও ফুটেজ, বই, ম্যাগাজিন, বুকলেট এবং বিদেশে বিভিন্ন মাধ্যমের কাছে থাকা প্রমাণ্য দলিল বিচার কাজে ভূমিকা রাখবে। তবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই কিছুটা সময় লাগবে। বিচার প্রক্রিয়া টাইমফ্রেম করে বলা সম্ভব না। সঠিক ও সুষুম বিচারের স্বার্থে ভালো-মন্দ দেখেই করতে হবে। রাতারাতি কোনো রায় কেউ দিতে পারে না। এ জন্য সময় লাগে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সব মামলা হয়েছে, সে গুলো ট্রাইব্যুনালের আওতায় আনার পরিকল্পনা কি?
গোলাম আরিফ টিপু : বিভিন্ন স্থানে যে সব মামলা হয়েছে, তার কাগজপত্র যদি আমাদের কাছে কেউ জমা দেয়, সেই মামলার বিষয়ে কাজ করবে ট্রাইব্যুনাল। তবে এক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল ওই সব মামলার কাগজপত্র দেখে সিন্ধান্ত নেবে। প্রয়োজন হলে নতুন করে তদন্ত করবে। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আহ্বান করছি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময়ে যে সব মামলা হয়েছে, সেগুলো ট্রাইব্যুনালে এসেছে, আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত গোলাম আজমসহ অন্যদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না কেন?
গোলাম আরিফ টিপু : আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও খুনি যারা যেখানেই থাকুন না কেন, তাদের রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। সময় তাদের গ্রেফতার করবে। সময় মতো তাদের তদন্ত শেষ হবে। সময় মতো তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অমানবিক ও হিংস্র আচরণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং অপরাধের প্রমাণের ভিত্তিতেই বিচার হবে। এক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিচার সম্পন্ন করতে ট্রাইব্যুনালের বর্তমান জনবল যথেষ্ট কি?
গোলাম আরিফ টিপু : শুরুতে প্রয়োজনীয় জনবল ছিল না। তবে পরবর্তী সময়ে চাহিদার বিপরীতে জনবল রয়েছে। এখন সেই সংকট নেই। ক্রমাগতভাবে আরও জনবল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি হচ্ছে। এক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন আমরা হচ্ছি না। যখন যা প্রয়োজন তা আমরা পাচ্ছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ট্রাইব্যুনালের কাজ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে কি?
গোলাম আরিফ টিপু : ট্রাইব্যুনালের কাজের ওপর নির্ভর করছে, কোন ধরনের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। তবে বর্তমানে নেই। ট্রাইব্যুনাল কাজ করে যাচ্ছে। তদন্ত সংস্থা সারাদেশে কাজ করছে। তদন্ত কাজের বিকেন্দ্রিকরণের দরকার আছে বলেও আমি মনে করি না। সম্প্রসারণের চেয়ে বিবেচ্য বিষয় হতে পারে, ট্রাইব্যুনাল জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করতে পারছে কি-না। আমি তো মনে করি দেশের মানুষ যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে আমাদের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। আমরা সেই দায়িত্ব পালন করতে সফলতার পথেই এগোচ্ছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যারা সাক্ষী দেবেন, তাদের নিরাপত্তার জন্য ট্রাইব্যুনাল কী ভাবছে?
গোলাম আরিফ টিপু : নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা শুরু থেকে শর্তকভাবে এগোবার চেষ্টা করছি। এ জন্য আমরা সরকারের ওপর চাপও সৃষ্টি করেছি। নিরপত্তার ব্যাপারে সরকারও উদ্যোগ নিয়েছে। সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধানে সরকার আইন করছে। আগামী সংসদ অধিবেশনে আইনটি পাসের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এই আইনের মাধ্যমে সাক্ষী ও অপরাধী উভয়ের যাবতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সাক্ষী ও অপরাধীর যাতায়াত, আদালতে আসা-যাওয়া, তাদের আপ্যায়ন এবং বিচার পরবর্তী সময়ে উভয়ের পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। আমরা আন্তর্জাতিক বিচার মুখে বললে হবে না। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে চাই। এ জন্য প্রতিটি ধাপে ধাপে কার্যত পরিক্ষা দিয়েই এগোচ্ছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিচার কাজ শেষে যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ সম্পর্কে জনগণকে জানানো হবে কি?
গোলাম আরিফ টিপু : এই বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি দেশের সচেতন বিবেকবান প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে। এরসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও শুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তা বাড়াতে হবে। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে সরকারকেও উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে মানুষ অপরাধীদের অপরাধ নামা সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারবে। কারণ বিচার তো সবার উপস্থিতিতেই হবে। বিচার প্রক্রিয়া যেহেতু উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় হচ্ছে। এখানে কোনো ধরনের ক্যামেরা ট্রায়ালের ব্যাপার নেই। পুরো বিশ্ববাসীর জন্য বিচার উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এই অবস্থায় পত্রিকা ও টেলিভিশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা প্রতিটি ঘটনার সত্যতা প্রকাশের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিলে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিচার সফল করতে ট্রাইব্যুনালে কোনো দুর্বলতা আছে কি?
গোলাম আরিফ টিপু : দুর্বলতা থাকলে, তা কাটাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আগেই নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমারা কোনো ধরনের দুর্বলতা দেখছি না। তবে আগাম কিছু বলাও যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জনগণের প্রত্যশা ও রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকারের মধ্যদিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে অভিযুক্তরা বলছেন, বিচারে রাজনৈতিক প্রভাব আছে। আপনি কি মনে করেন?
গোলাম আরিফ টিপু : রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কারণেই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে বিচার কাজে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব নেই। বিচারের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিকভাবে কারও বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়নি। প্রতিশোধমূলক কোনো আচারণ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই। দেশবাসী ও সরকার চায় প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাক। মানুষ অপরাধীদের চিনুক। তাদের অপরাধনামা সম্পর্কে দেশবাসী জানুক।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে রাজনৈতিক দলগুলো কোন ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
গোলাম আরিফ টিপু : বিচারে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলো সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ করছেনও। তবে তাদের কাছে ট্রাইব্যুনাল কোনো বায়না করছে না। করতে পারেও না। রাজনৈতিক দলগুলো যত দ্রুত গণমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারবে, বিচার প্রক্রিয়া তত দ্রুত এগোবে। জাতির বহুদিনের প্রত্যাশা ও আশা পূরণ হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : একটি মহল মনে করে বিচারে আন্তর্জাতিক চাপ আছে, এটা কি সঠিক?
গোলাম আরিফ টিপু : বিচার করার জন্য আমাদের জাতীয়ভাবে যে চাপ রয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবেও সেই চাপ আছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন মহল চায় সুষ্ঠুভাবে বিচার সম্পন্ন হোক। তারা ৭১ সালে বাংলাদেশে রাজাকার-আলশামস ও আলবদর বাহিনীর নির্যাতন দেখেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও মনে করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিরোধিতার নামে দেশের অভ্যন্তরে হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষণ ও জ্বালাও-পোড়াও করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। এই অবস্থায় অপরাধীদের পক্ষ শক্তির আন্তর্জাতিক অংশ বিচার চাচ্ছে না। আবার দেশের মধ্যে বিপক্ষে যে শক্তি আছে, তাদের পরক্ষ শক্তি বিভিন্ন স্থানে বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিচার প্রক্রিয়া আপনি এত আন্তরিকভাবে নিয়েছেন কেন?
গোলাম আরিফ টিপু : কোনো অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি তা দূর করতেই আন্তরিক হয়েছি। এই সংস্কৃতি কখনো কারও কাম্য হতে পারে না। যে কোনো সভ্য জাতির পক্ষে অপরাধীর অপরাধ সহ্য করা সম্ভব না। অপরাধ সহ্য করার সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন জাতি অগ্রসর হতে পারবে না। অপরাধকে দূর করতে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে জনগণ সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশকে ভালোবাসুন। দেশের স্বার্থে সরকারে ত্রুটিবিচ্যুতি সমাধানে এগিয়ে আসুন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনার অবদান অনেক। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিউকিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব পালন করতে কেমন লাগছে?
গোলাম আরিফ টিপু : এই কাজটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছি তা একটি স্বাধীন দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে, এই ধরনের দায়িত্ব নিতে সব সময় প্রস্তুত ছিলাম। এই দায়িত্ব পালন করতে পেরে নাগরিক হিসেবে অত্যন্ত গৌরব ও গর্ববোধ করছি। খুব স্বাভাবিকভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি। সবাইকে নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, তাতে আমরা জয়ী হবই। সামনে আরও কোনো চ্যালেঞ্জ এলে তাও নিতে প্রস্তুত আছি। এক্ষেত্রে আমি সব সময় লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি, সন্ত্রাস-ত্রাসসহ সবকিছুর ঊধর্ে্ব।
তারিখঃ মঙ্গলবার, ০৫ এপ্রিল ২০১১
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন!
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন!
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।