যে ঢেউয়ে ভেসে যায় সব

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১১

সামোয়াতে শেষবারের মতো সুনামি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এরপর বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হয়নি এখানকার বাসিন্দাদের। কিন্তু ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে আঘাত হানা সুনামিতে এলোমেলো হয়ে যায় সামোয়ার দরিদ্র মানুষগুলোর জীবন। সেই সুনামিকবলিত এলাকার মানুষগুলোকে বাঁচানোর জন্য কাজ করে যাওয়া জ্যাক ও ক্যারলকে নিয়েই আজকের গল্প।

জ্যাক-ক্যারল দম্পতি
জ্যাক-ক্যারল দম্পতি

রাতের আঁধার চিরে পুব আকাশে ঠাঁই নিয়েছে সূর্যটা। ভোর হয়েছে মাত্র। জানালা গলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকছে রোদ। বাইরে থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কোলাহল। জ্যাকের মস্ত বাংলোটা হঠাৎই কেঁপে ওঠায় ভেঙে যায় কাঁচা ঘুম। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে পোষা কুকুরটাকে খুঁজতে থাকেন জ্যাক। এটা কি ভূমিকম্প ছিল? আচমকা নীরব হয়ে যায় চারপাশটা। ঘটনা আঁচ করতে পেরে জেগে উঠেছেন জ্যাকের স্ত্রী ক্যারলও। দুজনই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ঘরের বাইরে যাবেন বলে মনস্থির করেন। জ্যাকের বাংলোর চারপাশটা ঘিরে আছে জংলা জায়গা। ধ্যানী ঋষির মতো ২০০ মিটার উঁচু এক পাহাড় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেই জংলার ভেতর। বাড়ির সামনেই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের এক বিশাল সমুদ্রসৈকত। বাংলোর জানালা দিয়ে আশপাশটা দেখতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় জ্যাকের। পাহাড়, জংলা ভেঙেচুরে ধেয়ে আসা মস্ত এক ঢেউ ছুটে আসছে বাংলোর দিকে। চিৎকার দিয়ে ক্যারলকে ডাকতে থাকেন জ্যাক। বিপদের আকস্মিকতায় হতভম্ব এই দম্পতি বুঝতে পারেন না কী করবেন। জ্যাকের প্রিয় বন্ধু ঘুমিয়ে আছেন দূরের একটি ঘরে। তাঁকে জানানোর জন্য ছুটতে থাকেন জ্যাক। ততক্ষণে বাড়ির ওপর আছড়ে পড়েছে ঢেউটা। ভাসিয়ে নিয়েছে যা পেয়েছে পথের সামনে।
অল্প বয়স থেকেই বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করেন জ্যাক ব্যাচেলর। খেলাধুলায় মেতে থাকা সদাচঞ্চল এই মানুষটির সমুদ্র বড্ড প্রিয়। ক্যারলের সঙ্গে বিয়ের পর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সমুদ্রের লোনাজলের ছোঁয়া নেওয়ার সুযোগ হয়নি তাঁর। সন্তানদের লালন-পালনের জন্য সব শখ ভুলে সংসার নিয়ে সময় কাটিয়েছেন এই দম্পতি। ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পর সমুদ্র, পাহাড় আর অরণ্যের কাছাকাছি থাকার শখটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জ্যাকের। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে উপলো সামোয়া দ্বীপের এক বাংলোয় বসবাস শুরু করেন জ্যাক ও ক্যারল। সামোয়ার সমুদ্রতীরবর্তী শান্ত পরিবেশে ব্যবসার জন্য রিসোর্ট তৈরি করেন জ্যাক। রথ দেখা এবং কলা বেচার মতো শখ পূরণের পাশাপাশি ব্যবসার কাজও করতে থাকেন জ্যাক ব্যাচেলর। ৫০ জন শ্রমিক নিয়ে স্বর্গের মতো সুন্দর এক রিসোর্ট দাঁড় করান তিনি। ব্যবসার পাশাপাশি সামোয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ শুরু করেন জ্যাক ও ক্যারল। ‘হাওয়াই শার্ট গায়ে চড়িয়ে পুরো দ্বীপটা চষে বেড়াই আমি। সহজ-সরল এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে ভালো লাগে আমার।’ সামোয়ার মানুষদের নিয়ে এভাবেই বলছিলেন জ্যাক। ভালোই চলছিল সব। জংলাপথে ঘুরে বেড়ানো, পাহাড়ের নীরবতায় হারিয়ে যাওয়া, সমুদ্রস্নানের পর দীর্ঘ সময় সৈকতে সূর্যের নিচে বসে বসে সময় কাটানো এসবেই কেটে যেত দিনের বেশির ভাগ সময়। কিন্তু ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরের সুনামি লন্ডভন্ড করে দেয় সব। কেড়ে নেয় ১৪৩ জনের প্রাণ। থমকে যায় সামোয়ার সহজ সরল মানুষগুলোর জীবনের স্বাভাবিক গতি।
২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় আঘাত হানা সুনামিতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি সামোয়ার মানুষের। সুমদ্রতীরবর্তী হওয়া সত্ত্বেও সেবার বেঁচে যায় তারা। সামোয়াতে শেষবারের মতো সুনামি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এরপর বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হয়নি তাদের। কিন্তু ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে আঘাত হানা সুনামিতে এলোমেলো হয়ে যায় সামোয়ার দরিদ্র মানুষগুলোর জীবন। সেদিন অল্প সময়ের ব্যবধানে রিখটার স্কেলে ৮ এবং ৭ দশমিক ৯ মাত্রার দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে সামোয়ায়। ৭ থেকে ৮ মিটার উঁচু উঁচু এক একটা ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব। ঢেউয়ের তোড়ে ভাসতে থাকা জ্যাক প্রথমে ভুলেই গিয়েছিলেন সাঁতরে প্রাণ বাঁচানোর কথা। লোনাজল গেলা ক্লান্ত শরীরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল জল। সংবিৎ ফিরে পেয়ে জ্যাক বুঝতে পারেন বাঁচতে হবে তাঁকে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন ভেসে যাওয়া গাছ, মৃত পশুর দেহ আর ঘরদোরের ভাঙা অংশ। মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিল আকাশ। সবকিছু ভুলে ঢেউয়ের ধরন বুঝে সাঁতরাতে থাকেন জ্যাক। জ্যাকের কিছু দূরেই ছিলেন ক্যারল। জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি পাইপ আঁকড়ে ধরে ছিলেন অনেকক্ষণ। একটা সময় থেমে যায় ঢেউ। সুস্থির থাকার জন্য ভয়ংকর এ বিপদ থেকে জ্যাক ও ক্যারল বেঁচে গেলেও হারান তাঁদের প্রিয় বন্ধুকে। জলের ওপর ভেসে ভেসে তীরে এসে পৌঁছায় প্রিয় বন্ধুর মরদেহ। তার পরের দিনগুলো খুব কষ্টের। নিজেরা অসুস্থ থাকার পরও পুরো দ্বীপের আহত মানুষগুলোর সাহায্যে কাজ শুরু করেন জ্যাক ও ক্যারল। স্বজন হারানো মানুষের কান্না আর আহাজারির ভিড়ে হারিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা। ‘দুঃস্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো। তবে জ্যাককে ফিরে পেয়ে খুশি আমি। আমি তো ভেবেছিলাম, আর কোনো দিন এই পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার সুযোগ হবে না আমার। হতাশ না হয়ে সামোয়ার মানুষকে নিয়ে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি আমরা’—বলছিলেন ক্যারল।


সুত্রঃ প্রথম আলো
তারিখঃ বুধবার, ৯ মার্চ ২০১১,

0 আপনার মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।

Avro Keyboard - Unicode Compliant FREE Bangla Typing Softwareবাংলা লিখার সপ্টওয়্যার আভ্র ডাউনলোড করতে খানে ক্লিক করুন
 
 
 

বিশাল বাংলা

কম্পিউটার প্রতিদিন

রাজনীতি...

বিনোদন

খেলার খবর

অর্থ ও বাণিজ্য