সংসদে ফিরেই সরকারকে সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ আখ্যায়িত করে অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানালেন খালেদা জিয়া। টানা প্রায় ১০ মাস পর গতকাল মঙ্গলবার সংসদে ফেরেন বিরোধীদলীয় নেত্রী। বিকেল পাঁচটায় অধিবেশন শুরু হয় স্পিকার আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে। কয়েক মিনিট পর অধিবেশনে ফিরেই বক্তব্য শুরু করেন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সংসদে ছিলেন না।
এক ঘণ্টা ১০ মিনিট স্থায়ী বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেত্রী দেশের বর্তমান অবস্থা, দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, শ্রমবাজার, বিচার বিভাগ, প্রশাসনে দলীয়করণসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে সরকারের সমালোচনা করেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপে ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকারকে ওই পথ থেকে সরে আসার আহ্বান জানান তিনি।

সংসদে খালেদা জিয়া
বিরোধীদলীয় নেত্রীকে সংসদে অভিনন্দন জানিয়ে স্পিকার বলেন, ‘মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা, আপনার আগমনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাকে সংসদে দেখলেই আমার ভালো লাগে। আশা করি, আপনাদের আগমনে সংসদ আরও বেশি কার্যকর ও অর্থবহ হবে। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা, আপনি এ পর্যন্ত পাঁচ দিন এসেছেন। এই পাঁচ দিনে আপনি দুই ঘণ্টা ১৮ মিনিট কথা বলেছেন। আমি কোনো বাধা দিইনি। আমি চাই, আপনি প্রতিদিনই আসেন। প্রতিদিন এসে কথা বলেন। আমি তো আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।’
প্রসঙ্গত, টানা ৭৪ কার্যদিবস পর বিরোধী দলের সদস্যরা গতকাল সংসদে আসেন। এর আগে সর্বশেষ এসেছিলেন গত বছরের ২ জুন।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘উচ্চ আদালতে দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরাই আজ বলছেন, সংসদ সার্বভৌম নয়। এ জন্যই আমি বলেছি, সংসদ ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিন, জনমত যাচাই করুন। কোন সংবিধানে দেশ চলছে আমরা জানি না। খসড়া সংবিধানে সরকার চলছে। আমি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ওই খসড়ার কপি চেয়েও পাইনি। এতে মনে হয়, দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম শূন্যতায় যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে।’
ডিজিটাল কারচুপি: শেয়ারবাজারে ডিজিটাল কারচুপি হয়েছে কি না, জানতে চেয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আপনারা যখনই ক্ষমতায় আসেন, তখনই কেন শেয়ারবাজারে এত ধস নামে? কেন এত লুটপাট হয়? আর সরকার কেনই বা নিশ্চুপ থাকে? অতএব বুঝতে হবে, “ডাল মে কুছ কালা হ্যায়”।’ তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের ধসে ইতিমধ্যে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এ ঘটনার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিকে লোকদেখানো কমিটি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
‘প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরাও চাই’ উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘কিন্তু যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। এটা দিয়ে বিচার সম্ভব নয়।’
ইউনূস প্রসঙ্গ: ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রসঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, এই সরকারের আমলে দেশে সম্মানিত ব্যক্তিরা সম্মান পাচ্ছেন না। কোনো সম্মানিত ব্যক্তি ভালো কাজ করলে তাঁর পেছনে লেগে যাওয়া হচ্ছে। ড. ইউনূসকে কেন অসম্মান করা হয়েছে, তা অবশ্য সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল ফাঁস করে দিয়েছেন। সন্ত্রাসী ও খুনি সন্তু লারমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর শান্তিতে নোবেল পাওয়া উচিত বলে দাবি করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, ‘সন্তু লারমা একজন সন্ত্রাসী। তাঁর সঙ্গে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর তুলনা হতে পারে না। সরকার এ বক্তব্যের প্রতিবাদ না করলেও আমি এর প্রতিবাদ করছি।’
দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা: দ্রব্যমূল্যের অবস্থা তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা যে চাল ১৬-১৭ টাকায় রেখে এসেছি, তা ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন সরকার ৪০ টাকায় উন্নতি করেছে। বর্তমানে সরকার মানুষকে ৫০ টাকায় চাল, ১১০ টাকায় ডাল, ১২০ টাকায় তেল খাওয়াচ্ছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ’৭২-৭৫ সালের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঘরেও মানুষের নিরাপত্তা নেই।
রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে দ্বৈতনীতির অভিযোগ করে খালেদা বলেন, সরকারের জন্য এক রকম আইন আর বিরোধী দলের জন্য অন্য রকম আইন। মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সরকারের দুই চোখ।
মহাজোটের শরিকেরা ভয়ে: মহাজোট সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টির প্রতি ইঙ্গিত করে খালেদা জিয়া বলেন, মহাজোটের শরিকেরাও সরকারের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। কিন্তু মন্ত্রিত্ব হারানোর ভয়ে সমালোচনা করে না।
ভারতের এক্সিম ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণসহ বিভিন্ন চুক্তির সমালোচনা করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করা হলে তা সংসদে উত্থাপন করতে হয়। কিন্তু সরকার তা করেনি। সীমান্তের কাঁটাতারে ফেলানীর মরদেহ ঝুলে থাকার বিষয়ে সরকারের নিশ্চুপ ভূমিকার সমালোচনা করেন খালেদা জিয়া। বলেন, সরকার প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি, এটা দুঃখজনক।
বর্তমান সরকারের আমলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই উল্লেখ করে খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, এজেন্সিগুলো এখন সংবাদপত্রে খবর ছাপানোর ওপর বিধিনিষেধ দিচ্ছে। সরকারের চেয়ে এজেন্সি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কারাবন্দী দলীয় সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সংসদে যোগদানের ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।
ওয়াকআউট: সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু হত্যার নায়ক উল্লেখ করে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের প্রতিবাদে ওয়াকআউট করেছে বিরোধী দল। গতকাল রাত সোয়া আটটার দিকে মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে ওয়াকআউট করেন বিরোধী দলের সদস্যরা। এ সময় বিরোধীদলীয় নেত্রী সংসদে উপস্থিত ছিলেন না।
রাষ্ট্রপতির ভাষণ সম্পর্কে আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে পাটমন্ত্রী আরও বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা বিএনপি ছেড়ে চলে গেলে আগামী দিনে আর বিএনপি ক্ষমতায় ভাগ বসাতে পারবে না। এ জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রীর শঙ্কা জাগে। এই বক্তব্যের সময় বিরোধী দলের সদস্যরা হইচই শুরু করেন।
0 আপনার মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।