শ্রাবণের শেষ স্মৃতি

মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০১১



শ্রাবণ মাস প্রায় শেষ। বাবার কাছে মা বায়না ধরলেন, তাঁকে বাপের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। অনেক কাকুতি-মিনতির পর বাবা রাজি হলেন। প্রতিবছর এই শ্রাবণ মাসেই একবার আমরা নানাবাড়ি যেতাম। কারণ, আমার নানাবাড়ি যেতে একটি বড় ও একটি ছোট নদী পার হতে হতো। বর্ষা মৌসুমে নদী কানায় কানায় ভরা থাকত বলে নৌকায় সহজেই পার হওয়া যেত। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীতে চর জাগলে নৌকা চলাচলে বিঘ্ন ঘটত। ট্রেনে চড়ব, নৌকায় উঠব, নদী দেখব—এ জন্য ছোটবেলায় নানাবাড়ি যাওয়ার কথা শুনলেই মন আনন্দে নেচে উঠত। দিন গুনতাম, কবে আসবে সেই দিনটি! যাওয়ার আগের রাত তো আনন্দে-কৌতূহলে ঘুমোতেই পারতাম না। সেদিন ভোরে আমরা রওনা হলাম। ট্রেন থেকে নেমে কিছু পথ গেলেই নদীর ঘাট। আমরা নৌকায় গিয়ে বসলাম। চকচকে সোনারোদ্দুর যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল! আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ জমতে লাগল। তবুও মাঝিরা নৌকা ছেড়ে দিলেন, কিন্তু মাঝনদীতে গিয়ে সে কি প্রচণ্ড বৃষ্টি! মাঝি ঠিকমতো হালও ঘোরাতে পারছেন না। এরপর নৌকা থামিয়ে সবাই ছইয়ের নিচে এলাম। বাঁধভাঙা বৃষ্টির পানিতে নৌকার প্রায় সবাইকে ভিজতে হলো। বৃষ্টি কিছুটা কমলে মাঝি আবার নৌকা ছেড়ে দিলেন, কিন্তু ঘাটে ভিড়তে ভিড়তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। নৌকা থেকে নেমে আট-দশ মাইল হাঁটা পথ, এর মধ্যে আবার কখনো বা হাঁটুপানি, কখনো কোমরপানি পার হতে হবে। মা-বাবার শরীর তখনো ভেজা। আমার প্রচণ্ড জ্বর এল। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন, মা পিছু পিছু। দুই-তিন মাইল হাঁটার পর আমরা এক বাড়িতে উঠলাম। আমার মা-বাবা শুকনো কাপড়চোপড় পরে আবার নানাবাড়ির পথে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন, কিন্তু সেই বাড়িওয়ালা ছিলেন ভীষণ অতিথিপরায়ণ। রাতটা তাঁদের বাড়িতে কাটাতে বললেন। আকাশে মেঘ, বাইরে ঘন অন্ধকার, আমার জ্বর বেড়েই চলেছে। রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য বাবাকে মা অনুরোধ করলেন। আমাকে নিয়ে মা-বাবা ভীষণ চিন্তিত। আশপাশে কোনো চিকিৎসক-ওষুধের বালাই নেই। এমন সময় ছোট্ট একটি মেয়ে বাবা-মাকে পানি খেতে দেয়। নির্মল, শুভ্র-শুচিশুদ্ধ, সাদামাটা, সরল-সুন্দর চেহারার ওই মেয়েটি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার মা-বাবা আমাদের খাওয়ানো থেকে শুরু করে শুইয়ে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজ যেন ওইটুকু মেয়ের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। প্রচণ্ড জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। মেয়েটি পানি এনে আমার মাথায় অনেকক্ষণ ধরে ঢেলে দিলো। এরপর মাথা মুছিয়ে দিয়ে সে চলে যায়। একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ মাথায় কিছুটা আরাম এবং কারও স্পর্শ অনুভব করি। চোখ মেলে টিপটিপ হারিকেনের আলোয় তাকে দেখে প্রথমে ভয় পেয়েছি। সে অনবরত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আমার মা-বাবা তখনো ঘুমোচ্ছেন। আমি অবাক বিস্ময়ে আবার কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। মেয়েটির নাম স্মৃতি। এরপর কত শ্রাবণ যে পেরিয়ে গেছে, সংসার আর বাস্তবতার রোষানলে হূদয়ে কত শ্রাবণধারা বয়ে গেছে, কিন্তু সেদিনের ওই ছোট্ট স্মৃতি আমার হূদয়ে চিরঅম্লান হয়ে রয়েছে।
মো. মাইদুল ইসলাম
কারমাইকেল কলেজ, রংপুর


সুত্রঃ প্রথম আলো
তারিখঃ মঙ্গলবার, ৮ মার্চ ২০১১

0 আপনার মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।

Avro Keyboard - Unicode Compliant FREE Bangla Typing Softwareবাংলা লিখার সপ্টওয়্যার আভ্র ডাউনলোড করতে খানে ক্লিক করুন
 
 
 

বিশাল বাংলা

কম্পিউটার প্রতিদিন

রাজনীতি...

বিনোদন

খেলার খবর

অর্থ ও বাণিজ্য