ইভ টিজারদের ক্ষমা নেই -মু.জোনায়েদ

রবিবার, ২০ মার্চ, ২০১১

ইভ টিজিং একটি সামাজিক ব্যাধি, একটি অশুভ সংকেত, নৈতিক স্খলনের বহি:প্রকাশ,সমাজবিরোধী জঘন্য ও গর্হিত কাজ। এ ব্যাধিতে ছেয়ে গেছে দেশ। কোনো ভাবেই ইভ টিজিং রোধ করা যাচ্ছে না। যতই এ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, লেখালেখি, মানববন্ধন,কার্টুন,ফিচার কিংবা আইন করা হচ্ছে, ততই ইভটিজাররা সোচ্চার আর হিংস্র হয়ে উঠছে।

রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ইলোরা, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার নুনিয়া পাড়া আলিম মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী শারমিন আক্তার, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সীমা বাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী রূপালি রানী টুনি, ফরিদপুরের মধুখালি উপজেলার হীরা ও মুক্তা, বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কচুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা অহিদুল্লাহ শেখরের স্কুল পড়ুয়া মেয়ে, ১৩ অক্টোবর বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিজয় নগরের এক ছাত্রী, ১৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার কুমিল্লার দেবিদ্বারে বিএসিসির প্রশিক্ষণ শিবিরের এক মেয়ে, গত ৮ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র সামনে এক ছাত্রী ইভ টিজিংয়ের শিকার হন। শুধু ছাত্রীরা নন চাকুরিজীবী, সন্তানের জননীরাও ইভ টিজিংয়ের শিকার।

সম্প্রতি নওগাঁ শহরের খাস নওগাঁ মহল্লার গৃহবধূ দু’ সন্তানের জননী ফৌজিয়া সুলতানা মুক্তি ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন। নাটোরের নারী উত্ত্যক্তকারী আসিফ ও রাজন, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার নুনিয়া পাড়া আলিম মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী শারমিন আক্তারকে ওই মাদ্রাসার শিক্ষক মো:জসিম উদ্দিন, সিরাজগঞ্জের রূপালি রানীকে ওই এলাকার বখাটে রাজমিস্ত্রী সুশীল চন্দ্র মন্ডল, বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কচুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা অহিদুল্লাহ শেখরের স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে ঐ এলাকার বিল্লাল হোসেন, মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের বিএসসি কলেজ শিক্ষক এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষকের নামে যৌন হয়রানি ও ইভ টিজিংয়ের অভিযোগ উঠে।

জানা যায়, চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ২০ জন তরুণী আত্নহত্যা করেছে। ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গত ১২ অক্টোবর মঙ্গলবার নাটোরের বাগাতি উপজেলার কৃষ্ণা কৃষিখামারের সামনে লোকমানপুর মহাবিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমান সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন । মাগুরা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শরিফুজ্জামানকে পেটানো হয় ও গায়ে গরম পানি ঢালা হয়। ফরিদপুরের চাঁপা রানী ভৌমিক বখাটের হামলার করুণ পরিনতি।

ইভ টিজিং স্কুল-কলেজ,মাদ্রাসা,বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টারে মধ্যে এবং আসা-যাওয়ার পথে বেশি ঘটে।

এক জরিপে দেখা গেছে,সারাদেশে যত ইভ টিজিং ঘটছে তার ৬৫-৭০ শতাংশ ঘটছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশে পাশে। মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটেছে ৭৮ টি, তবে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫৩ টিতে। মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাথে মূল্যবোধের অবক্ষয়ই ইভ টিজিংয়ের প্রধান কারণ।

সংবাদ পত্র,সামাজিক সংগঠনগুলো বেশ সোচ্চার হলেও এটা থামানো যায়নি। ইভটিজিং প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান, সাবেক সংসদ সদস্য ছাত্রবন্ধু মিয়া আবদুল্লাহ ওয়াজেদ শিক্ষার পাশাপাশি এখন ইভটিজিং প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি সমাজের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। দেশের জন্য ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো: মহসীন আলী বলেন, ইভ টিজিং একটি মারাত্মক ব্যাধি যা অহরহ ঘটে যাচ্ছে। আর তা ঘটছে নিজেদের পরিবার ও সমাজে। এ ব্যাপারে কঠোর আইন হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট’র আইন বিশেষজ্ঞ ফরিদা ইয়াসমীন বলেন, ইভ টিজিংয়ের শিকারে কেউ আত্মহত্যা করলে অপরাধীর শাস্তি কি হবে তা আইনে স্পষ্ট নয়। এ জন্য সরকারকে আরো কঠোর হবার দাবি জানান তিনি।

জানা যায়,জানুয়ারি থেকে ২০ অক্টোবর পর্যনত্ম ইভ টিজিং প্রতিবাদ করায় ২ জন নারী, ৯ জন পুরুষ খুন, আত্মহত্যা করে ২৫ জন নারী, ১ জন পুরুষ, আর লাঞ্ছিত হন ৬০ জন । সূত্র থেকে আরো জানা যায়, এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশ ইভ টিজিং এর ঘটনায় ১ হাজার ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করে, মামলা হয় ২৫ টি , আর অভিযোগ আসে ৮৩৪ জন বখাটের বিরুদ্ধে। তবে এদের মধ্যে মুচলেকার মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে ৪১৮ জন।

সারা দেশে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনী সতর্ক থাকলেও অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তবে এখন পর্যন্ত যতগুলো ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটছে তার মধ্যে বেশি ঘটনার জন্ম রাজশাহীতে। এছাড়া পিরোজপুর, বরিশাল, খুলনা, নওগাঁ, লক্ষ্মীপুর, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট ও রংপুরে কয়েকটি মামলা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, গত আগস্ট পর্যন্ত ইভটিজিং বা নারীদেরকে উত্যক্ত করার ঘটনায় সারাদেশে ১৫০ টি মামলা হয়েছে। জিডি হয়েছে ৩৭৭ টি আর ১ হাজার ২শত ৬৯ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহামুদ খন্দকার বলেন, ইভ টিজিং একটি সামাজিক সমস্যা। শুধু পুলিশ বাহিনীদের মাধ্যমে নির্মূল করা সম্ভব নয়। সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। উত্যক্ত করার ঘটনা পুলিশের নজরে আশার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশের কোন গাফিলতি নেই।

ইভ টিজিং কঠোর হস্তে দমন করার জন্য এরই মধ্যে কঠোর আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি পরীক্ষা করে যথাযথ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়। এতে উত্যক্তকারী ও তাদের অভিভাবকদের শাস্তির বিধান রেখে নতুন আইন করবে।

এছাড়া ইভ টিজিং রোধে দেশের প্রতিটি জেলা ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের প্রতি অ্যালার্ট জারি করা হয়। ইভ টিজিং রোধকল্পে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দেশের সকল জেলা প্রশাসক ও আইজিপি পুলিশের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। শুধু তাই নয়, ইভ টিজিংয়ে ভূক্তভোগীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইজিপিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইভ টিজিং প্রতিরোধে রাজধানীসহ সারা দেশে খুব শিগগিরই মোবাইল কোর্ট চালু হতে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা সরকারকে সাধুবাদ জানান।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, অধিকাংশ সময় মেয়েরাই ইভ টিজিংয়ের শিকার হন। তাই তাদের পোশাক পরিচ্ছদে শালীনতা আনার কথা বলেন তিনি।

তিনি আরো বলেন,নাটোরের শিক্ষক মিজানুর রহমানকে যারা হত্যা করেছে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রচলিত আইনের মাধ্যমে তাদের শাস্তি দেয়া না গেলে নতুন আইন করে হলেও ইভটিজারদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। গত ২ নভেম্বর সোমবার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেন ,খুব শিগগিরই ইভটিজারদের মোবাইল কোর্টের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, পরিবার থেকেই ইভটিজারদের সচেতন করা দরকার। এ জন্য পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ইভ টিজিং প্রতিরোধে সময়োপযোগী আইন নেই। নতুন আইন করে সামাজিক এ অপরাধ প্রতিরোধ করতে হবে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর ও প্রশংসানীয়।

৯ নভেম্বর মঙ্গলবার ইভ টিজিং প্রতিরোধের ক্ষমতা পায় ভ্রাম্যমাণ আদালত । ২০০৯ সালের প্যানেল কোড, ১৮৬০- এর ধারা আইনে ৫০৯ ধারা সংযোজন করা হয়েছে। সারাদেশে একযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয়দন্ডে দন্ডিত করতে পারবেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এতে বলা হয়, নারীর প্রতি অসম্মান,শালীনতাহানি, অঙ্গভঙ্গি, কটূক্তি বা শারীরিক বহি:প্রকাশ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যারা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে এবং মা-বোনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে তারাই ইভটিজার।

0 আপনার মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এমন কোন মন্তব্য করবেন না যা রাজনীতিক বা সামাজিক ভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করে।

Avro Keyboard - Unicode Compliant FREE Bangla Typing Softwareবাংলা লিখার সপ্টওয়্যার আভ্র ডাউনলোড করতে খানে ক্লিক করুন
 
 
 

বিশাল বাংলা

কম্পিউটার প্রতিদিন

রাজনীতি...

বিনোদন

খেলার খবর

অর্থ ও বাণিজ্য